ড. আনোয়ারা আলম »
‘রোকেয়া ছিলেন আমূল নারীবাদী, কিন্তু তিনি জানতেন তিনি পৃথিবীর এক বর্বর পিতৃতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত, তাঁকে বিদ্রোহ করতে হবে ওই বর্বরতাকে স্বীকার করেই।’
কথাগুলো হুমায়ূন আজাদের যিনি অপ্রিয় সত্যি বলতে ছিলেন এক নির্ভীক লেখক।
নারীবাদের নানা অপব্যাখ্যা এই একুশ শতকেও। কিন্তু এর মূল কথা একটাই- নারী পূর্ণাঙ্গ মানুষ, পুরুষের অধীন বা মালিকানাধীন প্রাণী নয়। বাকি আর সব কথা হচ্ছে এই কথাটারই বিস্তারিত ও প্রায়োগিক রূপ। সেখানে নানাপ্রকার মত আছে, পথ আছে, নানাপ্রকার শাখাপ্রশাখা আছে।কিন্তু মূল কথা একটাই। নারীও মানুষ। রোকেয়ার নারীবাদ ও ছিল এটাই। নারী পুরুষ মিলেই সমাজ।
তিনি বলছেন- ‘একটি শিক্ষিত নারী পুরুষের সমতূল্য হয় না, তিনি পুরুষের থেকে বেশি হবেন।’
‘সমাজের প্রগতি নির্ভর করে মহিলাদের স্বাধীনতা ও সমান অধিকারে’
‘নারীদের সাহস, পরিশ্রম এবং জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে যদি তারা সমাজে পরিবর্তন আনতে চান’
নারীদের মৌলিক অধিকার হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আত্মনির্ভর ও ন্যায়’।
রোকেয়ার সময়টা ছিল নারীর জন্য এক অন্ধকার যুগ।এ অন্ধকার শিক্ষাহীনতার যেখানে নারীরা ছিলেন অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা। রোকেয়ার জানা ছিল না, গুরু-শিক্ষক কেমন হয়। তবুও তিনি স্ব ও সুশিক্ষিত হয়েছিলেন। সহায়তা পেয়েছিলেন বড়ো ভাই, বড়ো বোন এবং স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের। যাঁর কারণে বিশ্বসাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়ে লিখেছেন Sultana’s Dream নামের এক চমৎকার ইউটোপিয়া। যে বইয়ে প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার। যা ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে এক পরম বিষ্ময়কর। তিনি এতোটাই সাহসী ছিলেন, এক সম্পূর্ণ নারী রাজ্যের কল্পনা করেছেন। এর চাইতে নারীবাদী ভাবনা আর কি হতে পারে।
তাঁর ভাষা যুক্তিনিষ্ঠ ও কেজো। লিখেছেন অশিক্ষা, অবরোধ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, নারীর অলঙ্কার প্রীতি ও উত্তরাধিকার প্রথার বিরুদ্ধে।
নারীবাদের মানবিক দর্শনকে সামনে রেখে নারীসমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তাঁর শিক্ষা প্রচেষ্টা শুরু। গতানুগতিক বিয়ে প্রথার বাইরে গিয়ে লেখেন- ‘কন্যা গুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, তাঁহারা নিজেদের উপার্জন নিজেরাই করুক। ‘অথচ সে সময়ে নারীশিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছিল কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়ে ছিল অস্পষ্টতা। শিক্ষিতা নারী কি করবে! পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে তার ভূমিকা কী হবে? একজন লেখক মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলি বলছেন ‘নারীদিগকে আমরা বিশ্বের জ্ঞানআলোকে পরিস্নাত করাইব, অধর্ম্মীয় পর্দার বাইরে আনিয়া মুক্ত আলো বাতাসের হিস্যা দান করিব,তাঁহাদের দেহ মনের পঙ্গুতা দূর করিব;কিন্তু তাঁহারা মূখ্যত আমাদের জননী, ভগীনী, গৃহিনী – ইহা বিস্মৃত হইব না’।
এমনকি তাঁর সমসাময়িক অনেক নারী লেখকও লিখেছেন অশিক্ষিত স্ত্রীর সান্নিধ্যে স্বামী ক্লান্তি বোধ করবে, ফলে সে বেশ্যালয়ে যেতে চাইবে। স্ত্রী শিক্ষার ফলে গৃহের পরিবেশ আনন্দময় হয়ে উঠবে যার দ্বারা স্বামী গৃহের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং সংসারের ভারসাম্য বজায় থাকবে। বিশেষত জননীর উপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া হতো।
কিন্তু রোকেয়া নারীকে দেখতে চাইলেন ক্ষমতার শীর্ষে। শামসুন্নাহার মাহমুদ বি,এ,পাশ করার পরে রোকেয়া তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করে সেখানে বললেন – ‘আমার সেই বত্রিশ বছর পূর্বের লেখা মতিচূরে কল্পিত লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টারের স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হইতে চলিয়াছে -আমার এ আনন্দ রাখিবার স্থান কোথায়?’
রোকেয়া তৎপর হয়েছিলেন রক্ষণশীল ও পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজের নারীর ভেতরের ও বাইরের উন্নয়নে। তিনি সহানুভূতির দৃষ্টিতে নয় নারীকে আপন শক্তিতে দাঁড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হিসেবে রোকেয়া পূর্বজদের থেকে এখানেই প্রগতিবর্তী। নারীর অধিকার নিয়ে তিনি কথা বলেছেন তবে তা বাইরের তত্ত্ব দর্শনের ওপর ভিত্তি করে নয় তার ধারই ধারেন নি তিনি। তাই তাঁর ভাবনা নিচ থেকে ওপরে উঠেছে। চারপাশের নারীসমাজকে তিনি দেখেছেন দরদী মন ও যুক্তি দিয়ে।
রোকেয়া প্রশ্ন তুলেছেন সম্পত্তি বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে অসমতার বীজকে তিনি পুরুষতান্ত্রিকতার ষড়যন্ত্র মনে করেছেন।তাঁর খোঁচাটা লক্ষ্য করা যাক। ‘আমরা পুরুষের অর্ধেক, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াই জন’ হই! ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে কি বিপ্লবী চিন্তা! নারী মুক্তির জন্য এমন কোন ভাষা নেই যা তিনি ব্যবহার করেন নি।
তাঁর পদ্মরাগ উপন্যাসের তারিনীভবন সংসার থেকে পালানো মেয়েদের কথা নয় বরং তাঁর নিজস্ব ঘর। যেখানে যে সংসার চিত্র তার মধ্যে প্রচলিত ধর্মীয় আচারবিচার বা রান্নার কথা নেই। আছে মানুষের সম্পর্কের জটিলতার কথা। বিবাহিত জীবনে ফেল করা মেয়েরা যেখানে আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গেছে। ধর্মীয় বিধিনিষেধমুক্ত পরিবেশে এরা স্বর্গতূল্য শান্তি অনুভব করেছে।
রোকেয়ার বিশেষত্ব এখানে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের চেয়ে বড়ো হয়েছে তাঁর সমাজ চিন্তা। এ উপন্যাস নতুন কথা বলেছে নবীনদের জন্য। নায়ক লতিফ বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার হলেও ব্যক্তিত্বহীন যা প্রমাণিত করে সে সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজে নায়কের কি দারুণ অভাব ছিল। পদ্মরাগ প্রকাশেরও দু’ৎবছর পরে যখন বাংলার তিন কোটি মুসলমানের ঘরে মাত্র একজন ঘর থেকে বের হওয়া নায়িকার প্রতিবাদিনী চিত্র তিনি এঁকেছেন। বাস্তবে না থাকলেও রোকেয়া তাকে সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরা অর্থাৎ নারীর সুশিক্ষা, অবরোধ মুক্তি আর মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার পাওয়া।শুধু কথা সাহিত্যে নয় রোকেয়ার সমগ্র রচনা এই আদর্শ প্রচারের উজ্জ্বল প্রয়াস।
কতোটা সাহসী হলে ঐ সময়ে তিনি ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে একদিকে পুরুষের একতরফা তালাক দেবার এবং বার বার বিয়ে করার শাস্ত্রসম্মত অধিকারের সমালোচনা করেছেন। ‘আমাদের ধর্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা? ’ এমন সরাসরি আক্রমণ খুব বেশি না করলেও পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেছেন বহুবার। তাঁর লেখনিতে এক সমালোচক আঁতকে উঠে বলেছিলেন যে, লেখক ক্রমাগত সমাজকে চাবকাইতাছে।’ এ সমালোচনা ছিল সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তির।
রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাবমূর্তি। আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের সহযোগী ধর্মকে। তিনি কোন বিশেষ ধর্মকে বাতিল করেননি, বাতিল করেছেন সব ধর্মকে। ১৯০৪ সালে যে কথাগুলো তিনি বলেছেন তা এই একুশ শতকে বলা হলে হয়তো তাঁকে প্রকাশ্যে রাস্তায় হত্যা করা হতো।
নারীবাদী স্যন্টন দেখেছিলেন, নারীমুক্তির বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্র সবসময়ে উচিয়ে ধরে বাইবেল, তাই তিনি বাতিল করে দেন বাইবেলকে। এরফলে হৈচৈ পড়েছিল পশ্চিমে। এর মাত্র নয় বছর পরে পৃথিবীর এক অন্ধকার কোণে মাত্র চব্বিশ বছরের তরুণী রোকেয়া লেখেন-‘আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারিনাই; যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনিই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি:এখনতো অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই শুনিতে পাই : পেটু তুই জন্মেছিস্ গোলাম। সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায়——-’।
রোকেয়া যে কর্মসূচি নিয়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে তিনি জায়া ও জননী, নারীর এই প্রথাগত ভূমিকাকেই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। ঐ অবরোধ যুগে তাঁর চিন্তা চেতনার মাঝে যে প্রগতিশীলতা, যে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যে বিদ্রোহ তা এই একুশ শতকেও পরম বিষ্ময়কর। গত নয় ডিসেম্বর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক আলোচনা বা পত্র পত্রিকায় লেখালেখি। তবে তাঁর মেধা প্রজ্ঞা ও চেতনাকে কতটা ধারণ করতে পেরেছি।সেটিই আসল বিষয়।