আবু মোশাররফ রাসেল »
দুরুগায়া
ইয়েলেনা তেরেসকোভা
তুমি এবং তোমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমার ভালোবাসা থাকলো। তোমাদের দেশে তুমি ছাড়াও আমি আরেকজন মানুষকে ভালোবাসি, তিনি তোমাদের প্রেসিডেন্টÑ ভøাদিমির পুতিন। কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণ করার কারণে তাকে এই মুহূর্তে আমি ভালোবাসা জানাতে পারছি না বলে দুঃখিত।
আমাকে ভালোবেসে, আমার প্রেমে পড়ে তুমি খুব দ্রুত বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছ বলে আজ আমি বাংলায় লিখছি। ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছুই করে। অল্প সময়ের চেষ্টায় আমার মায়ের ভাষা তুমি শিখতে পেরেছÑ এটা তোমার এক বিশাল গুণ, তোমার এই গুণ অতুলনীয়, তোমার প্রশংসা না করে পারা যায় না। আসলে তুমি কেবল রূপবতীই নও, যথেষ্ট গুণবতীও।
এই যে মন খুলে তোমার প্রশংসা করছি আমিÑআমাদের দেশে একজন মানুষ আরেকজনের এভাবে প্রশংসা করলে তা নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে। সেটাকে বলা হয় ‘তেল মারা’। আমার কলেজ জীবনে যে মেয়েটির সাথে প্রেম ছিল শুরুর দিকে তাকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ওর রূপ-গুণের যথেষ্ট প্রশংসা করতাম। ওর নাম ছিল সাবরিনা। আমি যখন কারণে-অকারণে সাবরিনার প্রশংসা করতাম তখন সে বলতোÑ থাক, আর ‘তেল মারতে হবে না’। আমাদের প্রেম গভীর হওয়ার পর সাবরিনা একদিন আমাকে বললো, ‘অকারণে অর্থাৎ যে প্রশংসা পাওয়ার মতো আসলেই যোগ্য নয় তার কখনও প্রশংসা করতে যাবে না, এসব ব্যক্তিত্বহীন মানুষের কাজ! অযোগ্য মানুষেরাই কেবল অন্যের কাছে প্রশংসা করে। অন্যের প্রশংসা আশা করে, প্রশংসায় গলে যায়, প্রশংসাকারীকে আপন ভেবে নেয়। এতে সে মতলববাজ মানুষদের সঙ্গ পায়, মতলববাজেরা তার স্বার্থ উদ্ধার হলে দ্রুতই সঙ্গত্যাগ করে। কিন্তু যোগ্য মানুষÑ তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে অপরকে আকৃষ্ট করবে, সম্মান অর্জন করবে, আপন করে নিতে পারে।’
কারও প্রশংসা করাটাকে ‘তেল মারা’ কেন বলা হয়? তা আমি অনেকদিন ধরেই বুঝে উঠতে পারিনি। সাবরিনাকে একবার জিগ্যেস করাতে সে খুব চমৎকার একটা উত্তর দিয়েছিল। সে রান্নার প্রসঙ্গ টেনে আমাকে বলেছিল, ‘আমরা যেমন মাছ-মাংস তেলে ভেজে, রান্না করে খাই, তেল মারা লোকজনও ঠিক সে রকম। তারা কাউকে তেল মারছে মানে বুঝতে হবেÑ সেই প্রশংসার তেলে ওই অন্যকে ভেজে খাওয়ার ফন্দি-ফিকির করছে। এর বাইরে কিছুই নয়।’ সাবরিনার কথাগুলো আমার কাছে যথেষ্ট যৌক্তিক মনে হয়েছিল এবং তা আমার ব্যক্তিত্বে একটা বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। তারপর থেকে আমি কারও প্রশংসা করতে পারি না; পাছে মানুষটা আমাকে ‘তেল মারা’ অযোগ্য, মতলবাজ বা ব্যক্তিত্বহীন ভেবে বসে।
অনেকদিন পর তোমার প্রশংসা করলাম, এটা তুমি ‘তেল মারছি’ বলেও ভেবে নিতে পারো। কারণ, আমি জানি যুদ্ধ এবং প্রেমের ব্যাপারে সবকিছুই বৈধ! তোমাদের প্রেসিডেন্ট পুতিন সাহেব ইউক্রেন আক্রমণ করার পর আমাদের দেশে তেল চরম আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে অবশ্য প্রায়ই একেক খাদ্যপণ্য, একেক সময়ে আলোচিত চরিত্র হয়ে ওঠে। সেই তালিকায় আছে- চাল, পেঁয়াজ, ডিম, কাঁচামরিচ ইত্যাদি। পবিত্র মাস রমজান আসার আগে থেকেই এ তালিকায় আরও কিছু পণ্য যুক্ত হয়ে বাজার গরম করে। আমরা সাংবাদিকেরা মিডিয়ায় তা নিয়ে যথেষ্ট মাতামাতি করি। রাজনীতিবিদেরা এসব নিয়ে টকশোতে পাল্টাপাল্টি কথাবার্তায়টেলিভিশনে শোরগোল তোলেন। কিন্তু দাম নামে না। অন্য পণ্যগুলো নিয়ে তোমাকে আরেকদিন বলব, এই মুহূর্তের আলোচিত তেলের বিষয়ে আজ বলছি। গত কয়েক মাস আগে থেকে আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের দাম হু হু করে বাড়ছিল। আমরা তখন পত্রিকায় ‘সিন্ডিকেটের কারসাজি’ বলে রিপোর্ট করলাম। এরই মধ্যে পুতিন সাহেব ইউক্রেন আক্রমণ করায় কারসাজির কারিগররা একটা মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেল!
যুদ্ধটা শুরু হয়েছে মাত্র এই কয়দিন হলো। ইউক্রেন থেকে আমাদের দেশে কতটা তেল আমদানি হয় আর সে দেশ থেকে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে আসতে কত মাস সময় লাগেÑ এসব সহজ হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার উত্তর দেয় যে, যুদ্ধটা কারসাজির অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়। সব হিসাব বুঝেও যখন তাদের দমানো যায় না, তখন তেল নিয়ে আরও নতুন নতুন ঘটনা ঘটে যায়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নতুন ঘটনা উদ্রেক হয়, সুযোগের সন্ধানে থাকা মানুষগুলো তৎপর হয় ওৎ পেতে থাকা শেয়ালের মতো। কিছু মানুষের মুখোশ খসে পড়ে তখন। কেউ কেউ ভিন্ন স্টাইলে প্রতিবাদও করে। তেল নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুয়েকটি ঘটনা তোমাকে বলছি।
বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখনই চড়া। এ সুযোগ কাজে লাগাতেই বাসায় তেল মজুদ শুরু করেন সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা। তিনি ৬ দিনে বাজার থেকে কিনে নিয়ে ৫১২ লিটার সয়াবিন তেল মজুদ করেন। তার পরিকল্পনা ছিল রমজানে চড়া দামে এসব বিক্রি করা।
এই লোক তো বাসায় মজুদ করেছিলেন। আরেকজন করছিলেন তার মুরগির খামারে। তিনি সেখানে ড্রামে করে প্রায় ৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেল মজুদ করেছিলেনÑ চড়াদামে বিক্রির উদ্দেশ্যে।
এভাবে মজুদ হয়তো ভেতরে-ভেতরে আরও অনেক মুনাফালোভীই করছে। তারা অবশ্য গাঁটের পয়সা বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে চেয়েছে। কিন্তু আরেক ব্যাপার ঘটেছে নিশিরাতে চুরি। এই লোকগুলো বাজারের দোকান থেকে তেলের আস্ত ড্রাম চুরি করে গাড়িতে তুলে গিয়ে গেছে।
তেলের দাম নিয়ে কেউ কেউ আবার ব্যতিক্রমী প্রতিবাদও করছে। এক দোকানদার স্যালাইনের টিউবে তেল ভরে সেটা থেকে তাওয়ায় ফোঁটা ফোঁটা তেল ফেলে পরটা ভেজেছেন। আরেক লোক বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে ৫ লিটার ভোজ্যতেল নিয়ে হাজির হয়েছেন, কয়েকজন গায়ক গানে গানে প্রতিবাদ করেছেন।
আমাদের দেশে তেল নিয়ে এসব ‘তেলেসমাতি’ আর মানুষের বিচিত্র সব কর্মকা-ের কথা শুনে তুমি ভেবে নিও না যে, এ দেশের মানুষ খুব খারাপ। সেই সাথে আমিও! আসল ব্যাপারটি বুঝতে হলে তোমাকে ঘটনার শেকড়ে যেতে হবে। একটা উদাহারণ দিই, ইউক্রেন আক্রমণের কারণে পশ্চিমারা যখন তোমাদের দেশের ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল, সাথে সাথে তোমাদের দেশের নাগরিকেরা ‘রুবল’ ঘরে তোলার জন্য ব্যাংকে ভিড় করল! এটাকে তুমি কিভাবে দেখবে?
বাস্তবতা হলোÑ আশঙ্কা। মানুষ নানা ধরনের আশঙ্কা থেকে, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিরাপদ বোধ করলেÑ এমন সব অবাস্তব কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। আর এ ব্যাপারে সব দেশের, সব কালের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অভিন্ন।সুতরাং, তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে ভালোবেসে যেতে পারো।
তোমার অনুরোধ ছিল, মিডিয়াকর্মী হিসেবে আমার দেশের পরিস্থিতি যেন তোমাকে লিখি। তাই চলমান আলোচিত চরিত্র নিয়ে লিখলাম। তো তেল প্রসঙ্গ নিয়েই আজ শেষ করি। বাস্তব জগতে যখন তেল নিয়ে হৈ চৈ রৈ রৈ অবস্থা। ভার্চুয়াল জগতেও তখন চলছে রমরমা মাতামাতি। নাহ, সেখানে কেউ তেল বিক্রি করছে, তা নয়। তেলের দাম যখন নাগালের বাইরে যেতে শুরু করে তখন থেকেই কিছু নারী ‘তেল ছাড়া রান্না শিখুন’ বলে ভিডিও দিচ্ছেন ইউটিউবে। সে ধরনের কয়েকটি চ্যানেলে ঘুরে দেখলাম লাখ লাখ ভিউ হয়ে যাচ্ছে কয়েক দিনেই। সুযোগে তারাও কামাই করছেন বেশ। অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগতেও তেলই নায়কের চরিত্র হয়ে গেছে! আবার এতে এটাও প্রমাণ হয়, অনেক মানুষেরই হয়তো এখন তেল কেনার সামর্থ্যটুকু নেই। তাই তারা তেল ছাড়া কিভাবে রান্না করা যায় তা শিখে নিচ্ছেন।
আচ্ছা তেরেসকোভা, তুমি কি রান্না জানো? শুনলাম, তোমাদের দেশের তরুণীরা এসব রান্নাবান্না নিয়ে পড়ে থাকে না, তারা যথেষ্ট স্বাধীন মনোভাবের। আমার খুব পছন্দের খাবার হলো আলুভর্তা, সেটার রেসিপি খুব সহজ। সরিষার তেল দিয়ে ভাজলে সেটা যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক হয়। স্পেনের অলিভ অয়েলেও খেয়েছি। এবার আমার খুব ইচ্ছে, ইউক্রেনের সূর্যমুখী তেলে আলুভর্তা খাবার। যুদ্ধে কে জিততে পারে বলে তোমার ধারণা? আমরা জানি যুদ্ধে কেউ জেতে না। তবুও বলছি, তোমার দেশ যদি ইউক্রেন দখলে নিয়েই নেয়, তাহলে খেরসন শহরে, আমাদের যেখানে দেখা হবে সেখানে অবশ্যই সূর্যমুখী তেলে ভেজে আলুভর্তা খাওয়াবে তুমি। খাওয়াবে তো?
নাকি এ যুদ্ধ তোমাকেও বিপন্ন করবে?