সাঈদুল আরেফীন :
রাসেল একা একা হাঁটছে। সবুজ ঘাসের ওপর। বাগানে এটা সেটা ধরছে। সকাল থেকে এক মুহূতর্ তার হাসুপাকে স্থির থাকতে দেয়নি। কখনো হাত ধরে হাঁটে। কখনো দৌঁড় দিচ্ছে। রাসেলের ইচ্ছে নিজে নিজে দৌড়াবে। হাসুপার হাত ধরে হাঁটবে। ওর যেন হাঁটার ইচ্ছা খুব বেড়ে গেছে। সারা বাড়িতে হাত ধরে ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের বারান্দা থেকে সামনের বারান্দা হয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরলো। হাঁটতে হাঁটতে চলছে। হাসুপাও রাসেলের পেছন পেছন যাচ্ছে। সেই প্রথম হাঁটা শুরু করল। কামাল ও জামালের নাম কখনও বলতো না। দিনের পর দিন চেষ্টার পর- একদিন বলেই ফেলল ‘কামমাল’, ‘জামমাল’।
আদনানকে যেনো গল্পের আকারে বলে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ শীর্ষক গ্রন্থের অংশবিশেষ থেকে তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন আদনানকে। শিশু আদনানকে আদর করে খুব কাছে টেনে নিয়ে এই গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর বলছেন, আমার সোনা ভাইটি ঠিক তোমার মতো ছিলো। রাতশেষে সকালে পেয়ারা গাছটার ফাঁক গলে চোখের ওপর আলো পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় কিশোর আদনানের। রোদের আলোয় চোখ কচলাতে কচলাতে আদনান বিছানা ছেড়ে ওঠে যায়। অবাক কা- হলো,এ গ্রন্থটি পড়তে পড়তে আদনান যে কখন রাতের আধারে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে টেরই পাইনি। রাতে পড়া গ্রন্থটি পড়তে পড়তে স্বপ্নের ভেতরে ডুবে যায় আদনান।
জাতির জনকের ছোট্ট শিশুপুত্র রাসেলের শৈশবের এ ঘটনাটির সাথে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুন্দরতম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্কুলে এসে আদনান গল্পের মতই একনাগারে পড়ে যাচ্ছিলো গদ্যটি। ক্লাশ ছুটি শেষে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিকথার অংশবিশেষ সাজিয়ে চমৎকার করে শেখ রাসেলের অজানা কথাগুলো বলেই আদনান থামতে চাইছে না। মাঝে মধ্যে সহপাঠী বন্ধু প্রশ্নও ছুঁড়ে দিচ্ছে। এটা আদনানের একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আজকাল। নিজে থেকে সে দেশের দুঃসহ ঘটনা ও স্মৃতিগুলো পড়ে এসে বন্ধুদের শোনায় আর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে। আদনানের পাশে সহপাঠীদের মধ্যে সামি,ফয়সাল, কামরুল, নাহিদও এসে যোগ দেয়। এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে একপ্রকার কৌতূহল তৈরি করে ফেলে আদনান। সামনেই পনেরোই আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস বলেই কথা। বন্ধুদের মধ্যে আদনানকে প্রশ্ন করে সামি- ‘শোক দিবসে তো আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকেসহ তাঁর পরিবারের আরো অনেককে মেরে ফেলা হয়, তুমি রাসেলের কথা কেন বলছো-ভাই?’
আরে বলবো না, রাসেল যখন মারা যায়, তখন তো আমাদের বয়সী ছিলো। ওর কথাই তো বলবো। জানিস বন্ধুরা, রাসেল কিন্তু খুব মেধাবী ছিলো। ছোটবেলা থেকে কষ্টে কষ্টে রাসেলের দিন কেটেছে। বাবাকে ভালো মতো দেখতেও পারতো না। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তো জেলে জেলে থাকতেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু দেশের নানাপ্রান্তে জনসভা করলে বঙ্গবন্ধুকে কাছেই পেতো না রাসেল। সত্যিই রাসেলের অনেক কষ্ট হতো, সামি ও ফয়সাল বলে ওঠে।
আদনানের কথায় বন্ধুরা সবাই একমত হয়ে একে অপরের মধ্যে বলাবলি করে। আমাদের দেশটার জন্য বঙ্গবন্ধু যেমন নিজের জীবনটাকে দিয়ে গেছেন। তাঁর ছোট্ট শিশু রাসেল সহ পরিবারের অন্য সবার জীবন দুষ্কৃতিকারীরা কেড়ে নিয়েছিলো। আদনান কাঁদো কাঁদো গলায় আরো বলে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাসেল ডাকতো ‘হাসুপা নামে। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে খুব ভালোবাসতেন। জানিস তোরা, রাসেলের জন্য বঙ্গবন্ধু কমিকসের মজার মজার বই নিয়ে আসতেন। হাসুপা রাসেলকে না খুব আদর করতেন। পরিবারের সবার নয়নের মণি ছিলো আমাদের রাসেল ভাইয়া। বন্ধুরা কষ্টের কথা কী জানিস- এতো সুখের পরিবারে কেন যে দুঃখের দিন এসেছিলো? দেশের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুসহ রাসেল ভাইয়ার মতো নিষ্পাপ শিশুকেও রেহাই দিলো না। বুলেটের আঘাতে অন্য সবার মতো রাসেল ভাইয়াকেও ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিলো। ঘাতকের দল ছোট্ট শিশু রাসেলের কান্না শোনেনি। বন্ধুরা জানিস তোরা, মাত্র দশ বছর বয়সী রাসেলকে মারতে গিয়ে ঘাতকদের বুক একটুও কাঁপেনি। আদনানের গল্প বলা যেন শেষ হয় না। প্রতিদিন একটু একটু করে রাসেলের ভয়াবহ মৃুত্যুর কথার সাথে জাতীয় শোক দিবসের কথাও বলতে থাকে।
আদনানসহ সব বন্ধরা স্কুলে এসে হাজির পরদিন। সবাই গোল পাকিয়ে বসে স্কুলের কমনরুমের বারান্দায়। রাসেলের ছোট্ট জীবনের বাকি অংশটুকুও একের পর এক বলতে থাকে। রাসেল ইউনিভার্সিটি লাবরেটরি স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলো। হাসিখুশি মুখ ছিলো। দশ বছর বয়সী রাসেল আমাদেরই মতো সুন্দর করে স্কুলে আসতো। পড়াশোনা করতো। গল্প করতো। আদনানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফয়সাল বলে, রাসেলের কথা, হাসুপা বা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গল্প তো শুনলাম। এবার আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলে কেমন হয়?
কিসের সিদ্ধানÍ দোস্ত? সামি প্রশ্ন করে।
সিদ্ধান্ত মানে কিছু না। মানে আমরা পাঁচবন্ধু মিলে আমাদের ক্লাশরুমটাকে সাজাবো। সুন্দর করে শেখ রাসেলের জন্মদিনটা পালন করতে চাই। আদনান তুই কী বলিস?
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে, খুব ভালো কথা।
কথায় কথায় গল্পের ছলে রাসেলেরর জন্মদিনটা পালন করার জন্যে সুন্দর একটা পরিকল্পনা করে বসে ওরা বন্ধুরা মিলে। যেই কথা সেই কাজ। ছোট্ট রাসেলকে নিয়ে ছোট্ট একটা অভিনয় করা যায় না, বন্ধুরা বলতেই আদনান বলে, তোরা যে যাই বলিস, রাসেলের ভূমিকায় আমিই অভিনয় করবো। ঠিক আছে বলে সবাই ওরা কথায় সায় দিয়ে কে কী করবে দায়িত্ব ভাগ করে নেয় বন্ধুরা সবাই। পরিকল্পনা করে কেউ রাসলকে নিয়ে ছড়া কবিতা পড়বে, আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা রচনা থেকে ছোট্ট নাটকটি লিখবে সামি। পনেরোই আগস্ট ঘাতকদের দ্বারা রাসেলকে মেরে ফেলার দৃশ্যও জুড়ে দিতে অনুরোধ করে বন্ধুরা।
দুয়েকদিন পরেই ক্লাসে এসে সবাই মেতে ওঠে অনুষ্ঠান নিয়ে। ক্লাসের টিচারকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে এক পলক দেখিয়েও নেয়। যথারীতি চললো রিহার্সাল। ক্লাস টিচার নিজেও একজন দক্ষ অভিনেতা। সব দিক গুছিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে ওরা রিহার্সাল করলো সামির লেখা ছোট্ট নাটকটিতে। প্রতিদিন সামিদের রিহার্সাল দেখে স্কুলের অন্য ক্লাসের টিচাররাও মুগ্ধ হতে লাগলো। সবাই বলাবলি করলো- শেখ রাসেলের জন্মদিনটা এবার বেশ জমজমাট হবে।
আঠারোই অক্টোবর। সকাল থেকে সামিসহ ওর বন্ধুরা বেশ তৎপর। সাজানো গোছানো হয়ে গেছে। বিকেলেই প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে এসে উপস্থিত। পুরো ক্লাসরুম জুড়ে রাসেলের বড়ো বড়ো ছবি সংগ্রহ করে সাজানো হয়েছে। রাসেলের শৈশবের নানা আকারের ছবিযুক্ত করে পেছনে কালো কাপড় দিয়ে শোকের ভাবনাটা বেশ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ক্লাস টিচার হামিদ স্যার এবার এসে বললেন, আর দেরি নয় প্রধানশিক্ষক স্যার আসছেন, তোমরা শুরু করো। স্যারের কথায় ক্লাস ক্যাপ্টেন নাহিদ একটু ভূমিকা দিয়ে প্রধান শিক্ষকের বঙ্গবন্ধু ও রাসেলকে নিয়ে কথা শুনলো। ছড়া কবিতা নাচ গান শেষে নাহিদের কণ্ঠে ঘোষণা এলো “ছোট্ট রাসেল” এর ওপর সামির লেখা নাটকটি দেখবেন, অভিনয় করেছে আমাদেরই ক্লাসের বন্ধুরা। ক্লাসের এক পাশে ছাত্র শিক্ষকেরা আর অভিভাবকদের জন্য বসার জায়গা দেয়া হয় অন্যপাশে। দৃশ্যপটে রাসেলের ছোটবেলার মতো মেকাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে আদনানকে। হাসুপার সাথে আধো আধো ভাষায় কথা বলা, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে ঘাসের বুকে ছুটে যাওয়া সব দৃশ্যের চমৎকার ভাবনার মিলন ঘটায় ওরা। রাসেলের স্মৃতির মধ্যে উপস্থিত দর্শকরা একাত্ম হয়ে যায়। শেষ দৃশ্যে টেনে হিচড়ে ওপরের কক্ষ থেকে রাসেলরূপী আদনানকে ঘাতকরা নিয়ে যাচ্ছে। রাসেল মুহিত ভাইয়ার গা জড়িয়ে ধরে বলে, মুহিত ভাইয়া আমাকে মারবে না তো। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে আরো বলতে থাকে, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা? এই চিৎকার চেঁচামেচিতে গুলির শব্দে মাটিতে ঢলে পড়লো শেখ রাসেল – ও মা, মা! তুমি কোথায়? শেখ রাসেলরূপী রক্তাক্ত আদনানকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে দর্শক সারিতে বসা আদনানের মা আবেগতাড়িত হলেন। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে আদনানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।