রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক : বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে

জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে ৪৪ লাখ নাগরিক রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায় আছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ রোহিঙ্গা, কুর্দি, ফিলিস্তিন জাতিগোষ্ঠীর। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রবিহীন এ মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। কারণ অনেক দেশই তাদের সীমানায় বসবাস করা রাষ্ট্রবিহীন মানুষের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করতে চায় না।
বিশ্বের রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি অন্তত ১২ লাখ এ মুহূর্তে অবস্থান করছে বাংলাদেশে। এদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা, যাদের জন্মভূমি মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। দুঃখজনক হলেও কক্সবাজার ও ভাসানচরের শিবিরগুলো আজ বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের ১৯৫৪ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, ‘স্টেটলেস’ বা রাষ্ট্রবিহীন হলেন এমন ‘একজন ব্যক্তি যাকে কোনো রাষ্ট্র তার আইনের অধীনে নিজের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে না’। অর্থাৎ তিনি একজন নাগরিকত্বহীন ব্যক্তি, কোনো দেশের নাগরিক নন, বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই তাকে নিজের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এ কারণে রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তিরা ভোটাধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি ও ভ্রমণের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে নানা দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ বাস্তুচ্যুতি শুরু হয় মূলত ১৯৭০-এর দশকে। ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২ ও ২০১৭—এ চার পর্বে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালাতে বাধ্য হন। এভাবে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রোহিঙ্গারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাদের সবেচেয়ে বড় গন্তব্য হয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। এছাড়া তারা আশ্রয় নিয়েছেন পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে। থার্ড কান্ট্রি রিসেটলমেন্ট হওয়া কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা আছেন ইউরোপ, আমেরিকাসহ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। সৌদি আরব, পাকিস্তান ও থার্ড কান্ট্রি রিসেটলড রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বহু ক্ষেত্রে সরকারিভাবে রেকর্ড হয়নি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে থাকেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। ২০১৭ সাল থেকে এসেছেন আরো সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেয়া ১২-১৩ লাখ রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে বসবাস করছে।

এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে তৎকালীন ক্ষমতাসীন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল, যার মধ্যস্থতায় ছিল চীন। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে সম্প্রতি মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেছে দেশটি। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত নয়।
এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ে বিপদে আছে বাংলাদেশ। অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যার সমাধান হবে তারও কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে তাতে এ ধরনের মানবিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ও বিশ্বনেতাদের হবে না।