রবীন্দ্রনাথের হেমন্ত বন্দনা

ইফতেখার রবিন »

বাংলার প্রকৃতি যেন ছয় ঋতুর এক অন্তহীন রূপকথা। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে নিজস্ব সুর, নিজস্ব ছন্দ, নিজস্ব রঙ ও ঘ্রাণ। এই ষড়ঋতুর মধ্যে যে দুটি ঋতু এখন ক্রমশ স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে, তার একটি নিঃসন্দেহে হেমন্ত। অথচ এ ঋতুই এক সময় কবি, সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞদের সৃষ্টিশীলতার উৎস ছিল। সেই হেমন্তের মুগ্ধতা ও ভাবলোকের সবচেয়ে গভীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, গানে ও দর্শনে।
হেমন্ত আসে শরতের শুভ্রতা পেরিয়ে, শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাসজুড়ে প্রকৃতিতে দেখা দেয় এক অন্যরকম রূপ। সকালের শিশিরভেজা ঘাস, খেজুরপাতা থেকে পড়া টুপটাপ ফোঁটা, মাঠে পাকা ধানের সুবাস সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সোনালি আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। ভোরের হালকা কুয়াশা, দুপুরের উজ্জ্বল আলো আর সন্ধ্যার মৃদু শীতল হাওয়া সব মিলিয়ে এক অনুপম শান্তি বিরাজ করে প্রকৃতিতে।
এই হেমন্তের রূপ কবিগুরুকে করেছে গভীরভাবে আবিষ্ট। তিনি হেমন্তকে শুধু প্রকৃতির ঋতু হিসেবে নয়, মানবজীবনের প্রাপ্তি, তৃপ্তি ও সংযমের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। তাঁর রচনায় হেমন্ত এসেছে ধীর শান্ত এক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচিন্তায় ঋতু শুধু সময়ের পরিমাপ নয়; এটি মানুষের মনের অবস্থা, জীবনের ছন্দের অংশ। তাঁর কবিতায় যেমন বর্ষা ও বসন্ত আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের প্রতীক, তেমনি হেমন্ত এসেছে পরিপূর্ণতার, পরিণতির ও প্রশান্তির প্রতীক হয়ে।
‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলোরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো…’
এই কয়েকটি পঙ্ক্তিতেই তিনি ধরেছেন হেমন্তের মৃদু মাধুর্য রাত্রির স্তব্ধতা, কুয়াশার চাদরে মোড়া আলোর আহ্বান। ‘হেমন্তিকা’ শব্দের ব্যবহার যেন প্রকৃতিকে নারীরূপে কল্পনা করে তার অন্তরঙ্গ কোমলতা প্রকাশ করেছে।
আবার ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি রৌদ্র’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘কার্তিকের এই ধানের খেতে/ভিজে হাওয়া উঠল মেতে/সবুজ ঢেউয়ের ‘পরে…’
এই পঙ্ক্তিতে কবি যেন হেমন্তের প্রাণবন্ত সুর তুলে ধরেছেন ধানের দোল, শিশিরের ছোঁয়া, প্রকৃতির জীবন্ততা।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় হেমন্ত শুধু দৃশ্যমান প্রকৃতি নয়, বরং অন্তর্লোকের প্রতিফলন। তাঁর দৃষ্টিতে হেমন্ত হলো এমন এক ঋতু, যেখানে প্রকৃতি স্থির হয়, কিন্তু জীবনের ছন্দ থেমে যায় না।
তাঁর কবিতায় আছে,
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে,/জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে,/শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার…’
এই ‘স্তব্ধতা’ ও ‘দীপ্তি’ হেমন্তের প্রকৃত সত্তা। এটি ধ্বনিহীন সৌন্দর্যের এক প্রশান্ত জগৎ যেখানে ফসল পাকে, মাটি সোনালি হয়, আর মানুষের মুখে ফিরে আসে তৃপ্তির হাসি।
রবীন্দ্রনাথের কাছে হেমন্তের এই শান্ত সোনালি পৃথিবীই প্রকৃতির চরম দান। তাঁর দৃষ্টিতে এটি নবান্নের ঋতু, ধরিত্রী মাতার উদারতা এবং মানুষের পরিশ্রমের ফলভোগের সময়। তাই তিনি লিখেছেন ,‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা,/ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে’
এই কবিতার ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ শুধু প্রকৃতি নয়, বাংলার মায়ের প্রতীক যিনি পরিশ্রমী সন্তানের ঘরে এনে দেন অন্ন, শান্তি ও আনন্দ।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বকে এক করে দেখেছেন। তাঁর কাছে হেমন্ত এমন এক সময়, যখন মানুষ তার পরিশ্রমের ফল দেখে, ক্লান্তি শেষে বিশ্রাম নেয়, জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করে।
যেমন বর্ষা মানুষকে উচ্ছ্বাস শেখায়, বসন্ত শেখায় প্রেম, শরৎ শেখায় স্বচ্ছতা তেমনি হেমন্ত শেখায় সংযম, পরিতৃপ্তি ও ধ্যানের গভীরতা।
তাঁর গানে, বিশেষ করে ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ ও ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে’ প্রভৃতি রচনায়, প্রকৃতির রূপের সঙ্গে এক অন্তর্মনীয় শান্তি মিশে গেছে।
এই সময়েই কবি প্রকৃতিকে দেখেছেন “বাহিরের সঙ্গে ভিতরের” মিলনে। অর্থাৎ হেমন্ত তাঁর কাছে ধ্যানের ঋতু, মগ্নতার ঋতু।
রবীন্দ্রনাথের সময়কার গ্রামবাংলা ছিল প্রকৃতিনির্ভর। কৃষকের ঘরে ধান ওঠার আনন্দ, নবান্ন উৎসব, ঢেঁকির শব্দ, পিঠা-পায়েশের গন্ধ সবই ছিল জীবনের অনিবার্য অংশ। তিনি সেই জীবনের সৌন্দর্যকেই হেমন্তে আবিষ্কার করেছেন।
হেমন্ত তাই তাঁর কাছে কেবল ঋতু নয়, বাংলার জীবন ও সংস্কৃতির প্রতীক যেখানে শ্রম, সৃষ্টিশীলতা ও আনন্দ একসঙ্গে মিশে আছে।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনায় প্রকৃতি এক প্রধান অনুপ্রেরণা। বর্ষা, শরৎ, বসন্ত যেমন তাঁর কবিতায় এসেছে আবেগে ও উৎসবে, তেমনি হেমন্ত এসেছে নিস্তব্ধ প্রশান্তির রূপে।
‘হেমন্ত’ তাঁর কাছে এমন এক রূপসী নারী যিনি কুয়াশার ঘোমটা টেনে নিজের সৌন্দর্য আড়াল করেন, কিন্তু তবু তাঁর উপস্থিতিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে।
হেমন্তের মধ্যেই কবি খুঁজে পান জীবনের পরিপূর্ণতা,
‘স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি/আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে।’
এই শান্তিই রবীন্দ্র-দর্শনের মূল: প্রকৃতি ও মানবের একাত্মতা।
রবীন্দ্রনাথের হেমন্ত বন্দনা কেবল ঋতু-বর্ণনা নয়, এটি এক দর্শনের রূপায়ণ যেখানে প্রকৃতি, শ্রম, সৃষ্টিশীলতা ও অন্তর্লোকের শান্তি মিলেমিশে গেছে। হেমন্তের ধানক্ষেতে, কুয়াশার ঘোমটায়, শিশিরের ফোঁটায় তিনি দেখেছেন জীবনের স্থিতি ও সৌন্দর্যের পরম প্রকাশ। বাংলার মাটি, মানুষের মুখ, ফসলের ঘ্রাণ, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি অনুভব করেছেন সেই অমলিন হেমন্তকে, যিনি সময়ের গহীনে হারিয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে।
তবু তাঁর গানের সুরে, কবিতার শব্দে, বাংলার প্রকৃতির বুকজুড়ে আজও বাজে সেই চিরচেনা আহ্বান-
“আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে”