রতন কুমার তুরী »
ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে সরাসরি সাক্ষাতের কথা তেমন একটা উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের বিভিন্ন কথাবার্তায় এবং তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন বইপত্রে তাঁদের মধ্যে যে একটি অদৃশ্য সম্পর্ক ছিল তার স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। একই সময়ে জন্মগ্রহণ করা এই দুজন বিখ্যাত মানুষের মধ্যে বলা হয়ে থাকে কখনও সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেনি। অথচ উক্ত সময়ে দুজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলেন এবং উভয়েই ভারতবর্ষকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরেছিলেন অনন্য উচ্চতায়।
এখন প্রশ্ন হলো, এ দুজন জ্ঞানী মানুষ একজন আরেকজনের সাথে কেনইবা যোগাযোগ করলেন না? অথবা সত্যিই কি এঁদের মধ্যে যোগাযোগ হয়নি? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো সত্য লুকিয়ে আছে। তবে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিবেকানন্দের কথা আসায় অনেকে ধারণাা করছেন যে, বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের কথা বা সাক্ষাৎ না হলেও তিনি যে বিবেকানন্দের মহৎ কৃতিত্বগুলো সম্পর্কে ভালোই খোঁজখবর রাখতেন, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রযুগে দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথেই রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল কিন্তু বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের কেন সাক্ষাৎ হলো না কিংবা হলেও কেন কোনো কথাবার্তা হলো না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। খুব সম্ভব বিবেকানন্দের চর্চার বিষয় ধর্ম হওয়ায় বিবেকানন্দ বরীন্দ্রনাথের মতো একজন বড় সাহিত্যিকের সাথে দেখা করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কিংবা বিবেকানন্দের বয়স রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দুবছর কম হওয়ায় তিনি হয়তো তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ববীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে উৎসাহী ছিলেন না। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দীপেন্দ্রনাথের সাথে বিবেকানন্দের বন্ধুত্ব থাকায় ছোট হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অত্যধিক সম্মানের কারণে রবীন্দ্রনাথের সামনা-সামনি কখনও আসতে চাননি। তাঁদের মধ্যে বয়সের ফারাক মাত্র দু’বছর। একে অপরের জন্মভিটেও মাত্র মাইল দেড়েকের মধ্যে। তা সত্ত্বেও কি দুজনের পরিচয় ছিল না? পরিচয় ছিল না বললেও কি খুব ঠিক বলা হয়? মুখোমুখি হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ইতিহাস আমাদের জন্য না রাখলেও তাঁরা যে একে-অপরের গুণগ্রাহী ছিলেন, সে বিষয়ে তো সন্দেহ থাকে না।
দুবছরের ব্যবধানে দুজনের জন্ম। একজনের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, অন্যজনের জন্ম কলকাতার কাছেই সিমলা স্ট্রিটে, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। দুজনে কি দুজনার কাছে আসতে পেরেছেন কখনও? এ নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আগে-পরে এবং সমকালীন বিভিন্ন মনীষী, বৈজ্ঞানিক ও মহান মানুষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো বলে জানা যায়। অথচ বিবেকানন্দের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়নি বা প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি এমনটা ভাবা বড় অদ্ভুত ঠেকে। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছিলেন তিনি অবশ্য বিবেকানন্দের শৈশববন্ধু। তখন তিনি নরেন। ‘স্বামী’ বিবেকানন্দ হননি। দ্বিজেন্দ্রনাথের আসরে নরেন আসেন নানা বিষয়ে আলোচনা ও গল্প করতে। নিত্য যাতায়াতের ফলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে নরেনের পরিচয় হয়। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম দর্শনেই পুত্রতুল্য এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হন। নরেনও এই মহর্ষির আচরণ ও নীতিনিষ্ঠায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমনকি বিবেকানন্দের ‘সংগীত কল্পতরু’তে রবি ঠাকুরের ১২টি গানও সংকলিত হয়েছে, যেগুলি নরেন ঠাকুর রামকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে গেয়ে শোনাতেন।
বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই শোনান ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’ প্রভৃতি। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, তা কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে।
দেবেন্দ্রনাথের কাছে নরেন্দ্রনাথের বারবার আসা-যাওয়ার সেই সময়ে তাঁর মনের যে গভীর আধ্যাত্মিক সংকট উপস্থিত হয়েছিল সে কথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘একদিন প্রাণের উৎকণ্ঠা নিয়ে স্বামীজি মহর্ষির কাছে উপস্থিত হলেন।’ তিনি যে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেকথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নরেন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করিতে করিতে ক্রমে রীতিমতো খাতায় নাম লিখাইয়া ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইলেন। এমনকি যখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্ববিখ্যাত হইয়াছেন তখনো হয়তো ব্রাহ্মদিগের খাতায় নাম ছিল’।(স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমভাগ : প্রমথনাথ বসু)।
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎকারের সেরকম কোনও তথ্যভিত্তিক ঘটনার উল্লেখ না পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে ভগ্নি নিবেদিতার ভূমিকাটি অস্বীকার করা যায় না। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি (১৮ মাঘ) মঙ্গলবার জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লেখা নিবেদিতার একটি পত্রে জানা যায়, নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মাঘোৎসবে বা অন্য কোনও সংগীতসভায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ দুটি গানও গেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কথাবার্তা হয়নি। নিবেদিতা লিখেছিলেন, ‘only there was some cloud- I could not tell what’. মেঘই থেকে গেল, আকাশ পরিষ্কার হল না। কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহসভায় ‘ব্রাহ্ম সুকবি’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন, তার একটি হল- ‘দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি বল দেব! কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়’।
বলাবাহুল্য দুটি হৃদয়ের নদী কোথাও মিলিত হল না। নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হওয়ার পর শাক্তধর্মের উপাসক হয়ে উঠলেন। অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের হয়েও সর্বোপরি মানবধর্মের কবি। আবার আমেরিকার শিকাগো ভাষণে বিবেকানন্দের মতো মানবধর্মের ওপর বড় ভাষণ খুব কমই শোনা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্রসৃষ্টির মধ্যে বিবেকানন্দের প্রতিফলন তাঁর জীবিত ও মৃত্যুর পরও বহু জায়গায় লক্ষ্য করা যায়। এমনকি, বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভাতেও রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রায় নীরব ও উদাসীন থেকেই গিয়েছেন। এছাড়া এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ, জাপানের বিখ্যাত কবি ওকাকুরা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গটি খুব গুরুত্বপুর্ণ। ভারতবর্ষকে বুঝতে ওকাকুরা বিবেকানন্দের কাছে গেলে তিনি বলেছিলেন- ‘এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান। তিনি এখনো জীবনের মধ্যে আছেন’। ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে গিয়েছিলেন। এ কথায় বিবেকানন্দের রবীন্দ্রপ্রতিভা ও সৃষ্টিকর্মকে সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপর দিকে ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative’. (Chintanayak Vivekananda pg. 981)।
পরবর্তীকালের ইতিহাসে কিন্তু দুজনের জীবন মোড় নিল দুদিকে। একজন সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টির সুতোয় মালা গাঁথলেন, নোবেল পেলেন। এশিয়া মহাদেশে ভারতকে সবাই চিনল আর অন্যজন ভারতকে বিশ্বের দরবারে বিভিন্ন দিক থেকে মহান করে তুললেনÑ বিশেষ করে ধ্যানে, ত্যাগে, সেবায়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে সামনা-সামনি সাক্ষাৎ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ থাকলেও উক্ত দুজন জ্ঞানী মানুষ একে অপরের খবর রাখতেন এবং একে অপরের লিখিত গ্রন্থসমূহ পড়তেন। তা তাঁদের বিভিন্ন কার্যকলাপ ও তাঁদের লেখনি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। এ দুজনের সম্পর্ক বিষয়ে ভারতবর্ষর বেশ কিছু বিদগ্ধ লেখক এবং গবেষক এখনও গবেষণা করে চলেছেন। অদূর ভবিষতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আধ্যাত্মিক এবং জ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তা হয়তো আমরা জানতে পারবো। তবে বর্তমানে
প্রাপ্ত সকল তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা স্পষ্ট বলতে পারি যে, বিবেকানন্দেরর সাথে রবীন্দ্রনাথের তেমন একটা সম্পর্ক ছিল না। তবে তাঁরা দুজন দুজনের লেখা পড়তেন এবং রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বিষয়ে যথেষ্টই খোঁজখবর রাখতেন। তবে খুব সম্ভবত বরীন্দ্রনাথের ভাইপোর সাথে
বিবেকানন্দের বন্ধুত্ব থাকায় বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের খোঁজখবর সব সময় পেতেন বলেই হয়ত বরীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়নি।
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল কিংবা সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তাঁদের তা হয়তো অদূর ভবিষতে আমরা জানতে পারবো। তবে এ দুজন বিখ্যাত মানুষ তাঁদের নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে ভারতবর্ষকে যে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।