যেসব প্রাণী একে অন্যকে উপহার দেয়

ছবি: ডাল-ই ভিয়া চ্যাটজিপিটি

সুপ্রভাত ডেস্ক  »

পাখিদের ক্ষেত্রেও উপহার দেওয়ার বিষয়টি দেখা যায়। যেমন: পুরুষ গ্রেট গ্রে শ্রাইক কাঁটা বা ডালে ছোট ছোট প্রাণীকে বিদ্ধ করে, তারপর প্রণয়ের সময় সঙ্গীকে মুগ্ধ করার জন্য সেগুলো উপহার হিসেবে দেয়। তবে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পোকামাকড় এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাকড়সার মধ্যে।

আমরা হয়তো মনে করি উপহার দেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য। তবে জানা যায়, মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে অন্য অনেক প্রাণীও তাদের সঙ্গী বা সহচরদের উপহার দিয়ে থাকে।

যদি বড়দিনের সকালে পাওয়া উপহার আপনার পছন্দ না হওয়ায় হতাশ হন, তবে এটা ভেবে খুশি হোন যে আপনি অন্তত কোনো নারী স্করপিয়নফ্লাই হয়ে জন্মাননি।

যদি নারী স্করপিয়নফ্লাই হতেন, তাহলে আপনি বড়দিনে আপনার প্রিয়জনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে একদলা থুতু পেতেন। হ্যাঁ ঠিকই দেখছেন, সঙ্গীর লালা দিয়ে তৈরি বল পেতেন।

যদিও হতাশ হওয়া তো দূরের কথা, স্ত্রী স্করপিয়নফ্লাই এই সুস্বাদু খাবার উপভোগ করে এবং তাদের সঙ্গীদের তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে পুরস্কৃত করে।

এছাড়া শামুক, কেঁচো ও স্কুইডসহ নানা প্রজাতির মধ্যে নাফশাল গিফ্ট বা বিবাহ উপহার [ প্রণয় বা প্রজননের সময় পুরুষ প্রজাতির সদস্য তার নারী সঙ্গীকে উপহার হিসেবে যে খাবার দেয়] দিয়ে থাকে।

পাখিদের ক্ষেত্রেও উপহার দেওয়ার বিষয়টি দেখা যায়। যেমন: পুরুষ গ্রেট গ্রে শ্রাইক কাঁটা বা ডালে ছোট ছোট প্রাণীকে বিদ্ধ করে, তারপর প্রণয়ের সময় সঙ্গীকে মুগ্ধ করার জন্য সেগুলো উপহার হিসেবে দেয়।

তবে এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পোকামাকড় এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাকড়সার মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ- পুরুষ সিক্স-স্পট বার্নেট মথ তার সঙ্গীকে তার শুক্রাণুর মাধ্যমে সায়ানাইড উপহার দেয়।

অন্যদিকে, নার্সারি ওয়েব মাকড়সা সম্ভাব্য সঙ্গীকে রেশমে [মাকড়সার জাল] মুড়িয়ে এনে শিকার উপহার দেয়।উপহারটি আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এর সঙ্গে বাড়তি রাসায়নিক উপাদান মেশানো থাকে। যদি নারী সঙ্গী শিকারটি গ্রহণ না করে, তবে পুরুষ মাকড়সাটি ফের আরও বেশি রেশম দিয়ে উপহারটি মুড়িয়ে আবার সেটি উপহার দেয়।

কখনও কখনও পুরুষ মাকড়সারা তাদের সঙ্গীকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা নিম্নমানের শিকার বা অর্ধেক খাওয়া শিকারের টুকরো রেশমে মুড়িয়ে উপহার হিসেবে সঙ্গীদের দিয়ে থাকে। নারী সঙ্গীটি এটিকে কোনো আকর্ষণীয় উপহার মনে করে এবং তা খুলতে ব্যস্ত থাকে, সেই সুযোগে পুরুষ মাকড়সা তার সঙ্গে মিলিত হয় এবং নারী মাকড়সাটি আসল ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে যায়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারী সঙ্গীকে পুরুষ নার্সারি ওয়েব মাকড়সাদের দেওয়া উপহারের মধ্যে ৭০% নকল।

কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহেভিওরাল ইকোলজিস্ট ড্যারিল গুয়েন বলেছেন, ‘পুরুষেরা মাঝে মাঝে প্রতারণা করার চেষ্টা করে। তারা একটি পুরনো, কীটপতঙ্গের শুকনো পা, বা অন্য যেকোনো কিছুই মুড়ে এনে দেয়।’

গুয়েন বলেন, ‘আমার বাড়ির কাছেই বসন্তকালে একটি খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। পুরুষ ডান্স ফ্লাইরা নদীর উপর দিয়ে উড়ে উড়ে জলজ পোকামাকড় শিকার করে নিয়ে আসে। এরপর নারী ডান্স ফ্লাইরা এই শিকার পেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। কারণ এরা নিজেরা খাবার সংগ্রহ করতে পারে না এবং ডিম উত্পাদন করার জন্য তাদের এই পুষ্টি প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকবার আমি দেখেছিলাম একটি পুরুষ ডান্স ফ্লাই উইলো বীজ থেকে তৈরি তুলার বল এনে স্ত্রী সঙ্গীকে উপহার হিসেবে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।’

সঙ্গীনিকে নকল উপহার দিয়ে কিছু সময়ের জন্য পুরুষটি স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সে ক্ষতিগ্রস্তই হয়। কারণ সঙ্গীনিটি যখন বুঝতে পারে বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে, তাৎক্ষণিক সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

এর মানে হলো, পুরুষটি শুধুমাত্র তার সঙ্গে একবারই কিছু সময়ের জন্য মিলিত হতে পারে। নারী পতঙ্গ সাধারণত একাধিক পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়, তাই অসৎ পুরুষের শুক্রাণু থেকে নারীটির ডিম নিষিক্ত করার সম্ভাবনা কম থাকে, অর্থাৎ সে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিছু পতঙ্গ সঙ্গীনিকে আকৃষ্ট করতে বিপজ্জনক আত্মত্যাগ করে। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষ সেজব্রাশ ক্রিকেট (এক ধরনের পতঙ্গ) সঙ্গমের সময় নারীটিকে তার পিছনের ডানা কামড়ে খেতে দেয়। এমনকি তাকে তার হেমোলিফ (পোকার রক্তের সমতুল্য) পান করতে দেয়।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একবার পুরুষরা এই ‘ভালোবাসার কামড়’ সহ্য করার পর, তাদের আরেকটি সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। কারণ তারা আর অন্য কোনো রোমান্টিক সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না।

পুরুষ রেড ব্যাক স্পাইডারও মিলনের সময় চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করে। সে তার সঙ্গীনিকে তার পেটের শেষ অংশ কামড়াতে দেয় এবং এভাবেই একসময় নারীটি পুরুষ সঙ্গীটিকে একটু একটু করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে!

এই কৌশলটি পুরুষ স্পাইডারের জন্য চূড়ান্ত আত্মউৎসর্গেরই নামান্তর, কারণ মিলন শেষেই সে প্রাণ হারায়। তবে, এই আত্মত্যাগের পিছনে একটি প্রজনন কৌশল কাজ করে: পুরুষ মাকড়সাটি তার শুক্রাণু প্রবাহিত করতে আরও সময় পায়, যা তাকে ভবিষ্যতে বেশি বাচ্চা পৃথিবীতে রেখে যাওয়ার সুযোগ দেয়।

ওয়াইনে নামের এক গবেষক বলছেন, ‘একভাবে বলা যায় সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ এর ফলে সে তার প্রাণ হারায়। কিন্তু ডারউইনীয় প্রজনন দৃষ্টিকোণ থেকে, রেড ব্যাক স্পাইডারদের মধ্যে নারী খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ ও সৌভাগ্যের বিষয়। তাই সঙ্গীনিকে খাবার দিয়ে বিভ্রান্ত করার মধ্য দিয়ে সে তার মিলনকে দীর্ঘায়িত করে এবং তার মধ্যে আরও বেশি শুক্রাণু রেখে যেতে পারে। ফলস্বরূপ বেশি বাচ্চা রেখে যাওয়ার সুযোগ পায় সে।’

২০২২ সালে চীনের জিয়াংসু একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস এর কীটতত্ত্ববিদ চুফেই তাং এবং তার সহকর্মীরা ৯৯ মিলিয়ন বছর পুরনো অ্যাম্বারে পতঙ্গের উপহার দেওয়ার একটি নমুনা আবিষ্কার করেন।

প্রাচীন এই অ্যাম্বারের ভেতরে তারা পায়ের মাঝে শ্লেষ্মা দিয়ে তৈরি একটি খালি, ফেনাযুক্ত বেলুন বহনকারী আলাভেসিয়া প্রজাতির একটি পুরুষ মাছি দেখতে পায়।

এগুলো সবই নাফশাল গিফ্ট। প্রজনন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নারী সঙ্গীকে প্রলুব্ধ করতে পুরুষেরা এই উপহারগুলো দেয়।

সাধারণত এসব উপহারের পুষ্টিগত মূল্য থাকে, তাই নারী সঙ্গীও এসব উপহার থেকে উপকৃত হয়।

তবে কখনও কখনও শুধুমাত্র কাউকে আনন্দ দেওয়ার জন্যও প্রাণীদের উপহার দিতে দেখা যায়। যেমন: ডলফিনদের মানুষকে ইল, টুনা মাছ ও অক্টোপাস প্রভৃতি খাবার উপহার দিতে দেখা গেছে। এছাড়াও, কিছু কাকের কথা শোনা গেছে, যারা অতীতে তাদের সাহায্য করেছিল এমন মানুষদের উপহার দেয়।

অর্থাৎ, সাধারণত প্রজননের উদ্দেশ্যেই প্রাণীরা তাদের সঙ্গীদের উপহার দেয় ও গ্রহণ করে। তবে মাঝে মাঝে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যও অনেক প্রাণী অন্যকে উপহার দিয়ে থাকে।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক জ্ঞানের অধ্যাপক নিকোলা ক্লেটন বলেন, ‘আমি কাকের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি। যেমন: আখরোট, জলপাই, বিয়ারের বোতলের মুখ এবং ওয়াইন কর্ক।’

বৃহত্তর কাক পরিবারের সদস্য ইউরেশিয়ান জে তাদের সঙ্গীদের শুধুমাত্র উপহার দেওয়ার আনন্দে উপহার দেয়।

ক্লেটন এবং তার দলের একটি পরীক্ষায়, পুরুষ পাখিরা কয়েকবার তাদের সঙ্গীদের শুধু মথ বা কৃমি খেতে দেখানো হয়। এরপর যখন পুরুষটি তার সঙ্গীকে রসালো খাবার দেওয়ার সুযোগ পায়, তখনই তার সঙ্গীকে বিভিন্ন ধরনের খাবার এনে দিতো।

অন্যভাবে বললে বলতে হয়, পুরুষ পাখিরা বুঝতে পেরেছিল নারী পাখিরা বারবার একই খাবার খাওয়ার বদলে বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করে।

বোনোবোদের মধ্যেও পরার্থপর উপহার দেওয়ার বিষয়টি প্রচলিত। বোনোবো হলো বানরদের একটি প্রজাতি, এর ডিএনএ মানুষের সঙ্গে প্রায় ৯৯% মিলে যায়।

২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঠিক মানুষের মতো বোনোবোরাও কখনও কখনও অপরিচিতদের সাহায্য করতেও উপহার দেয়।

বোনোবোদের তাদের দলের সদস্য না এমন বোনোবোদের সঙ্গেও নিজেদের আপেল, কলা ও অন্যান্য খাবার ভাগ করে খেতে দেখা গেছে।, এমনকি তারা অপরিচিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করার জন্যও নিজেদের খাবার ভাগ করে নেয়।

গুয়েন বলেন, ‘মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য- কেন প্রাণীরা একে অপরকে উপহার দেয়? যেহেতু একাধিকবার বিভিন্ন প্রজাতিকে কাজটি করতে দেখা গেছে, তাই ধারণা করা হয় এটি সম্ভবত পুরুষ ও নারী উভয়েরই প্রজনন সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। পোকামাকড় ও মাকড়সার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই সত্য- তবে এক্ষেত্রে যদি কোনো পক্ষ ধোঁকা দেয়, তাহলে বিষয়টি ভিন্ন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি এমন যে সে [পুরুষ সঙ্গীটি] তাকে একটি খাবার দিচ্ছে এবং বিনিময়ে সে [নারী সঙ্গীটি] তাকে তার প্রজনন অঙ্গের প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।’

এই আচরণটিকে ঠিক রোমান্টিক উপহার বলে মেনে নিতে না পারলে, আপনি অন্তত এ কথা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন যে, অন্যান্য প্রাণী যেমন কাক ও বোনোবোও উপহার দিয়ে আনন্দ পায়।

ক্লেটন বলেন, ‘পোকামাকড়ের জগতে পুরুষ উপহার দেয় যাতে সে সঙ্গীনির সঙ্গে মিলিত হতে পারে, কিন্তু বিনিময়ে তারা সারা জীবনের জন্য সঙ্গী হয়। তাই এটি কোনো ঘুষ নয়, এটি একটি উপহার।’

তিনি আরও বলেন, ‘কাক অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দীর্ঘজীবী প্রাণী। একটি সম্পর্ক অর্জন করা এক জিনিস, তবে বহু বছর ধরে এটি বজায় রাখা অনেক কঠিন। তাই উপহার হল প্রশংসার প্রতীক।’

তাই ইউরেশীয় জে এর মতো কাকদের ক্ষেত্রে, উপহার দেওয়ার পিছনে মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত মানুষের মতোই– আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা। সূত্র: জেসমিন ফক্স-স্কেলি, বিবিসি