সড়কজুড়ে চরম অব্যবস্থাপনা
‘মুরাদপুর ও জিইসি মোড়ে ল্যাপলেইনে কিছুটা সুফল মিলছে’
রাজিব শর্মা
নগরীর সব সড়কেই তীব্র যানজট। এতে শুধু নগরবাসীর ভোগান্তি নয়, সময়েরও অপচয় হচ্ছে। প্রশিক্ষণহীন চালক, ফুটপাত ও রাস্তার একপাশ দখল করে ভাসমান ব্যবসা, যত্রতত্র পার্কিং, যানজট নিরসনে সংশ্লিষ্ট সংস্থার তেমন কেনো উদ্যোগ না থাকায় সড়কজুড়ে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা।
গতকাল রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে নগরীর আগ্রাবাদ, ইপিজেড, বন্দর, এক্সেস রোড, আন্দরকিল্লা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, লালখানবাজার, জিসি ২ নম্বর গেইট মোড় ঘুরে দেখা গেছে যানজটের বেহাল চিত্র। এসব যানজটে যাত্রীদের আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এসব যানজটের জন্য প্রশিক্ষণহীন ড্রাইভার ও কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করছেন পথচারীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পার্কিং করে রাস্তা দখল করে রাখে বিভিন্ন যানবাহন। অন্যদিকে টাইগারপাস, ইপিজেড মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে ইচ্ছেমতো।
হাটহাজারী থেকে মুরাদপুর রোডে ভোগান্তি
নগরীর হাটহাজারী থেকে মুরাদপুর সড়কে যানজট যেন নিত্যসঙ্গী। পথচারীরা পার হচ্ছে জ্যামে আটকে পড়া গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে। এ রোডের বাসগুলোতে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর মুরাদপুরের এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তায় বসে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ। যাত্রীরা বলেন, আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি থেকে আসা গণপরিবহনগুলোকে মুরাদুপর ফ্লাইওভারের মুখে এসে থেমে থাকতে হতো। কিন্তু এখন মুরাদপুর রাস্তার মাথা ওয়াসার পানি প্রকল্পের কাজের কারণে রোডটি সাময়িক বন্ধ থাকায় যাত্রীদের গাড়ি পাল্টাতে হচ্ছে, না হয় বায়েজিদ দিয়ে ঘুরে ২ নম্বর গেট দিয়ে নগরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। ফলে সহজে গাড়ি ঢুকতে না পারার কারণে অক্সিজেন থেকে ২নম্বর গেট সড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে বহদ্দারহাটের এক কিলোমিটার এলাকা থেকে শুলকবহর পর্যন্ত এক কিলোমিটার দীর্ঘ এমএ মান্নান ফ্লাইওভার থাকলেও এটি গাড়ি যাতায়াতে তেমন ব্যবহার হচ্ছে না। ফ্লাইওভার এড়িয়ে নিচের সড়কপথ ব্যবহার করছে অধিকাংশ গাড়ি। ফলে বহদ্দারহাট মোড় ও এর দু’পাশে লেগে থাকা যানজট যেন যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। তাছাড়া শুলকবহর পার হলেই মুরাদপুর। আর মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের কারণে মানুষের ভোগান্তিরও শেষ নেই।
অন্যদিকে ওয়াসার’র সাইনবোর্ড লাগিয়ে মুরাদপুর রাস্তার মাথায় উন্নয়নের কাজ চললেও ঐ কাজের সাথে ওয়াসা কোনভাবে জড়িত না বলে জানান চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘মুরাদপুরের যেটি রাস্তা বন্ধ করে কাজ চলছে তা আমাদের আওতায় না। ওখানে আমাদের সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে আরেকটি সংস্থা। আমরা একাজের সময়সীমা সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।’
অন্যদিকে ট্রাফিক জ্যামে যাত্রীদের ভোগান্তি নিরসনে মুরাদপুর ও জিইসি মোড়ে ল্যাপলেইনের ( রাস্তার বাম পাশে এক মুখী রাস্তা) ব্যবস্থা নিয়েছেন চসিক। যা নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক উত্তর বিভাগ। তবে এতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন ট্রাফিক কর্মকর্তারা। তবে এ পদ্ধতিতে যানজট কমলেও বিপরীত মোড় ঘুরে গিয়ে গন্তব্য পৌঁছাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে বলে মনে করছেন ড্রাইভাররা।
রাঙামাটি থেকে আসা পাহাড়িকা বাসচালক মো. মাসুদ বলেন, আমরা অক্সিজেন যাত্রী নামিয়ে দিই, যার ফলে মুরাদপুরে গাড়ি যেতে হচ্ছে না। তবে মুরাদপুরের গাড়িগুলো ২নম্বর গেট দিয়ে ঘুরে এসে অক্সিজেন এসে জমায়েত হওয়ায় জ্যামে আটকে পড়ে।
বায়েজিদ থেকে মুরাদপুর আসা এক ট্যাক্সিক্যাব চালক বলেন, ‘আগে আমরা যেভাবে সহজে যেতে পারতাম, এখন তা পারছি না। এখন ওয়ানবাই রোড। অনেকদূর পর্যন্ত গিয়ে মোড় ঘুরে গন্তব্যের রাস্তায় যেতে পারছি। তবে দীর্ঘ যানজটে বসে থাকার চেয়ে দেরিতে হলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছি।’
ল্যাপলেইনের সুফল প্রসঙ্গে মুরাদপুর গোল চত্বরে দায়িত্বে থাকা সার্জেন্ট শিমুল মাহমুদ বলেন, ‘জিইসি মোড়ে এ সিস্টেম অনেক আগে চালু করলেও মুরাদপুর গোল চত্বরটি চালু করা হয়েছে ১০/১২ দিন হচ্ছে। এতে প্রবর্তক, বায়োজিদ ও বহদ্দারহাট থেকে আসা গাড়িগুলোকে আগের মতো দীর্ঘ জ্যামে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।’
ড্রাইভারদের দীর্ঘ পথ ঘুরে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা বুঝতে পেরেছি। আমরা শীঘ্রই ডিসি ও চসিক বরাবর চিঠি পাঠাবো যাতে গাড়ি চলাচলের জন্য মাঝখানে আরেকটু খোলার ব্যবস্থা রাখে।’
গতকাল সকাল ১০টায় মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার সড়ক পরিদর্শনে দেখা যায়, চারিদিকে শুধু যানজট। অন্যদিকে বহদ্দারহাট থেকে চকবাজার ও টাইগারপাস হয়ে অনেক যাত্রী চলাচল করছে। কিন্তু গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ওই রুটটিতে দেখা দিচ্ছে যানজট। বিশেষ করে এ সড়কের চকবাজার, চট্টগ্রাম কলেজ ও কাজীর দেউড়ি মোড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া অক্সিজেন, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ও আমবাগান হয়ে একটি চলাচলের বিকল্প রাস্তা থাকলেও এটি দিয়ে যানবাহন চলাচল করে খুবই কম। ফলে মূল সড়কে যানজট কমছে না।
এ বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘যানজট নিরসনে আমরা নগরীর জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেট ও মুরাদপুরে ল্যাপলেইনের ব্যবস্থা করেছি। আমরা বেশ সুফলও পাচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেকটা যানজট কমে এসেছে। আমরা বহদ্দারহাট মোড়ও করবো। তাছাড়া এ লাইন করতে যথেষ্ট জায়গার প্রয়োজন হয় ,যা নগরীতে নেই। গাড়ি বাড়ছে, মানুষ বাড়ছে কিন্তু রাস্তার প্রশস্ততা বাড়েনি। ফলে যানজট নিরসনে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।’
আগ্রাবাদ থেকে টাইগারপাস
গতকাল বেলা ১২টা। আগ্রাবাদ থেকে টাইগারপাস এলাকায় ছিলো দীর্ঘ যানজট। এখানে একেকটি জ্যাম দেড় থেকে দুই ঘণ্টার ওপর লেগে থাকে। এতে নগরবাসী দুষছেন ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনাকে। ঘণ্টা পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক যাত্রী হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হচ্ছেন।
বাসের যাত্রীরা জানিয়েছেন, টাইগারপাস ও ইপিজেড মোড় এলাকায় ট্রাফিক পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলা আর যততত্র স্থানে ব্যাটারিচালিত গাড়ির সংখ্যা বাড়ায় জ্যামের সৃষ্টি।
এক যাত্রী বলেন, ‘আজ (গতকাল) ইপিজেড থেকে বাসে নিউমার্কেট আসতে দেড়ঘণ্টা লেগেছে। অসহনীয় এ যানজট নিরসনে প্রশাসনের বিকল্প চিন্তা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।’
যানজট নিয়ে বন্দর ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যানজট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে আইনত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের ল্যাপলেইন করার চিন্তা আছে কিন্তু পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাছাড়া এখন উন্নয়নের কাজ চলছে। এখন যদি ল্যাপলেইন করি আরো যানজট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এছাড়া নিউমার্কেট মোড় থেকে লালদীঘি হয়ে আন্দরকিল্লা টেরিবাজার মোড় পর্যন্ত প্রায় সময় দেখা যায় দীর্ঘ যানজট। এরমধ্যে জিপিও’র বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত ফুটপাত ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের দখলেই। এতে কোন ধরনের তদারকি নেই বললেই চলে। স্থানীয়রা এসব যানজটের জন্য দায়ী করছেন ভ্রাম্যমাণ দোকানদার ও প্রশাসনের নীরবতাকে।
আন্দরকিল্লার এক লাইব্রেরি ম্যানেজার বলেন, ‘আন্দরকিল্লার রাস্তাটি অনেক আগেই বিভিন্ন প্রভাবশালী, হকার্সদের নিয়ন্ত্রণে। ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো পুরো রাস্তা দখল করে আছে। জেনারেল হাসপাতালের সামনের রাস্তাটিও কম্বল বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তায় যেন যানজট সৃষ্টি না হয় আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু কিছু স্থানে ল্যাপলেইন করার।’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ (চউক) এর উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈশা আনসারী বলেন, ‘নগরীর এমন কোনো স্থান নেই যেখানে যানজট জটিলতা নেই। যেখানে চারলেনের রাস্তা হলেই তিন লেন দখল হয়ে যায়। এখন আর ফুটপাত দেখা যায় না। সুতরাং পুরো শহর রাস্তা করলেও হবে না যতক্ষণ না ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঠিক হচ্ছে।’
নগরীর যানজট নিরসনে মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি নগরীর ট্রাফিক বিভাগকে বলেছি যেন যানজট নিরসনে তারা নতুন কোন পদক্ষেপ নেয়। ল্যাপলেইনের সিদ্ধান্ত নিতে বলেছি। বহদ্দারহাট ও সল্টগোলা ক্রসিংয়ে ফুটওভার ব্রিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া চসিক কর্তৃপক্ষ রিকশার ড্রাইভারদের জন্য ডিজিটাল নাম্বার প্লেইটের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অনেকটা যানজট কমবে বলে বলে আশা করছি।’