সুপ্রভাত ডেস্ক »
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, কেবল একাত্তরের ভূমিকার জন্য নয়, সাতচল্লিশের ভারতভাগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কোনো ‘ভুল’ করে থাকলে তার জন্য শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইছে জামায়াত।
সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রথম দিন স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি দলের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের কথা স্পষ্ট করেন।
শফিকুর রহমানের ভাষায়, “এই কিছুদিন আগে এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব যখন ফ্রি হলেন জেল থেকে, তখন আমি বলেছি, ‘শুধু একাত্তর না, সাতচল্লিশ সাল থেকে শুরু জামায়াতে ইসলামীর দ্বারা কেউ যদি কোনো কষ্ট পান; কারো যদি কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে; আমি সব ব্যক্তি এবং সংগঠনের পক্ষে নিঃশর্তে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই, আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করবেন।”
তিনি বলেন, “আজকের দিন পর্যন্ত আমরা ভুল করি নাই-এ কথা বলব কীভাবে? আমরা মানুষ, আমাদের সংগঠন একটা মানুষের সংগঠন; আমাদের একশটার মধ্যে ৯৯টা ডিসিশন সঠিক, একটা তো বেঠিক হইতে পারে। সেই বেঠিক একটা ডিসিশনের জন্য আমার জাতির তো কোনো ক্ষতিও হতে পারে। তাহলে সেই ক্ষেত্রে আমার কোনো ডিসিশনে জাতির ক্ষতি হলে আমার মাফ চাইতে অসুবিধা কোথায়?
“এখন মাফ চাওয়ার পরে বলে যে, ‘এই ল্যাঙ্গুয়েজে চাইলে হবে না, ওই ল্যাঙ্গুয়েজে চাইতে হব ‘। … বিনা শর্তে মাফ চাইলাম, কোনো শর্তও দিলাম না; তারপর আর বাকি থাকল কোনটা, এটা তো বুঝি না।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতে ইসলামীর তরফে প্রথম নিঃশর্ত ক্ষমতা চাওয়া হয় গেল ২৭ মে। সেদিন যুদ্ধাপরাধের মামলায় দলের নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম খালাস পাওয়ার পর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চেয়েছিলেন শফিকুর রহমান।
তিনি বলেছিলেন, “যখন যেভাবে হোক, মানুষ আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে না। দল হিসেবে আমরা দাবি করি না যে- আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে।
“এই সংগঠনের প্রতিটি কর্মী, সহকর্মী কিংবা দলের দ্বারা যে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন; সবার কাছে কোনো শর্ত নাই, বিনা শর্তে মাফ চাই। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।”
তবে সেদিন সুনির্দিষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। তার পাঁচ মাসের মাথায় এ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করলেন জামায়াত আমির।
শফিকুর বুধবার নিউ ইয়র্কে বলেন, “একাত্তরে জামাতের কোনো ভূমিকা ছিল না? অবশ্যই ছিল। জামায়াত তখন ফিল করেছিল যে, পাকিস্তান ইউনাইটেড থাকা দরকার। তখনও কিন্তু পাকিস্তান; আওয়ামী লীগের বহু লিডার পাকিস্তান সরকারের আন্ডারে চাকরি করেছে। বেতন নিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের লিডার পরিবারের অনেকে তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারের রেশন নিয়েছে। বেনিফিট নিয়েছে।
“আমাদের কোনো আপত্তি নাই। বিপদের সময় এটা সরকারের দায়িত্ব। নাগরিকদেরকে দেখা- দেখেছে। সে কোন দলের, এটা আমাদের দেখার ব্যাপার না। সেগুলো বাস্তবতা।”
তিনি দাবি করেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ‘প্রায় ৯০ ভাগ জায়গায়’ পাকিস্তানের পতাকা উড়েছে।
“অফিস-আদালতে পাকিস্তানের নামে সবাই চাকরি করেছে। ১৫ তারিখ থেকে এই সিনারি পুরাপুরি চেঞ্জ হয়ে গেছে। পরবর্তী দুই দিনে ওই পতাকাও নেমে গেছে। চাকরিও বন্ধ হয়ে গেছে।
“এর আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে যারাই কাজ করেছেন, তারা পাকিস্তানকে মেনে নিয়ে কাজ করেছে। এখন এটা বলতে পারেন জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে, জনপ্রত্যাশা ছিল যে পাকিস্তানের শাসকরা চলে যাক। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাক। জামায়াত এটাকে সম্মান করল না কেন? এটা একটা লেজিটিমেট কোশ্চেন। করলে ভালো হত, করা উচিত ছিল; এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নাই।”
শফিকুর বলেন, “বাট এই আনসারের উপযুক্ত ব্যক্তিটা আমি না। কারণ আমাদের যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ তখন যারা ছিলেন, কোন প্রেক্ষাপটে তারা কোন ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছেন—সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তাদের জীবদ্দশায় এই সমস্ত প্রশ্নের বহুবার উত্তর তারা দিয়েছেন।
“এখন জাতির কিছু কিছু লোক বলতো যে, ধরে নিলাম যে আপনারা স্পেসিফিক কোনো ক্রাইম করেন নাই। তার পরেও আপনাদের পলিটিক্যাল এই ডিসিশনটা জাতি মেনে নেয় নাই। আপনারা তো একটা অ্যাপোলজি দিলেই পারেন। এই অ্যাপোলজি আমরা মিনিমাম তিনবার দিয়েছি।
“প্রফেসর গোলাম আজম সাহেব দিয়েছেন, মাওলানা মতিউর রহমান সাহেব দিয়েছেন এবং আই মাইসেলফ, আমি দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “আজকে আবার প্রকাশ্যে বলে গেলাম, সাতচিল্লশ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে কষ্ট পেয়েছেন, আমরা বিনা শর্তে যারা কষ্ট পেয়েছেন, তাদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই। কোনো অসুবিধা নাই।”
জামায়াত আমির বলেন, “আমি এ কথা জীবনে বলি নাই, আমার কোনো সহকর্মী বলেন নাই, আমার সিনিয়র যারা ছিলেন, তারা বলেন নাই যে—আমরা সকল ভুলের ঊর্ধ্বে। কোনো দল যদি দাবি করে যে তারা সকল ভুলের ঊর্ধ্বে—অবশ্যই জাতি এটা মানবে না।
“তো আমাদেরটা মানবে কেন? তাই আমাদের জানা-অজানা, যত ভুল হয়েছে; এই ভুলগুলো যারা শুধরে দিয়েছেন, তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আর এই ভুলের দ্বারা যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোন, আমরা তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন—কোবা আয়োজিত এ মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন জামায়াতে ইসলামের যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়কারী নাকিবুর রহমান। কুইন্সের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা পার্টি হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন জামায়াত আমির।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, “প্রশ্ন করেছেন, আমরা যদি দেশ পরিচালনার সুযোগ পাই, তাহলে দেশটা কি আফগান হবে, নাকি ইরান হবে, নাকি ইন্দোনেশিয়া হবে না লেবানন হবে, না পাকিস্তান হবে? আমরা যদি সুযোগ পাই—এটা বাংলাদেশ হবে, ইনশাআল্লাহ। এটা অন্য কোনো দেশ হবে না।
“আমাদের দেশের কৃষ্টি, কালচার, সভ্যতা, যুগের পর যুগ মিলেমিশে চলার যে সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, তার মধ্যে যে দু-চারটি কাল দাগ পড়েছে, ওগুলোকেও আমরা উপড়ে ফেলব ইনশাআল্লাহ; যাতে এখানে দল-ধর্মের ব্যবধানের কারণে জাতি আর বিভক্ত না হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা এখন আর মেজরিটি-মাইনোরিটি- এটাও আমরা স্বীকার করি না; আমরা বলি ‘উই নিড ইউনিট’। আপনি যখনই মেজরিটি-মাইনোরিটি বলবেন, তার মানে একটা দেশকে দুভাগে ভাগ করবেন। এবং একদল আরেক দলের মুখোমুখি হয়ে যাবে। সেই কাণ্ড-কারখানাটাই তো আমরা ৫৪ বছর দেখেছি। ওটা আর আমরা দেখতে চাই না।”
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শফিকুর বলেন, “মানুষ নিজের তার জায়গা শিফট করতে পারে; কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না। আমরা আমাদের প্রতিবেশীকে রেসপেক্ট করতে চাই। একইভাবে আমরা আমাদের প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাওনা রেসপেক্টটুকু চাই। এটা হতে হবে মিউচুয়াল রেসপেক্টের ভিত্তিতে।
“এখানে আমরা সমতার কথা বলছি না। কারণ, ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের চেয়ে ২৬ গুণ বড় একটি দেশ; দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ। তাদের রিসোর্স, ম্যানপাওয়ার, ল্যান্ড হিউজ দ্যান আওয়ার পিপল।”
তিনি বলেন, “আমরা তাদেরকে তাদের জায়গায় সম্মান করতে চাই। কিন্তু আমাদের যে ছোট্ট একটি ল্যান্ড আছে, আর ১১৮ মিলিয়ন পপুলেশন আছে, এটাকেও তাদের রেসপেক্ট করতে হবে। দিস ইজ আওয়ার ডিমান্ড। যদি এটা হয়, তাহলে দুই প্রতিবেশী শুধু ভাল থাকব না, এক প্রতিবেশীর কারণে আরেক প্রতিবেশী বিশ্ব দরবারেও সম্মানিত হব।”
বিএনপির সঙ্গে টানাপড়েন প্রসঙ্গ
১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠনের মত যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে। এরপর ১৯৯৯ সালে দল দুটি জোট গঠন করে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের জয়ের পর খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রিত্ব পান তখনকার জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমানী নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ।
প্রায় দুই যুগ টিকিয়ে রাখা জোট ভেঙে দেওয়া হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। সে সময় বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে জামায়াত ও বিএনপি দুই দলই বেকায়দায় ছিল। গতবছর অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিএনপি ও জামায়াতের ফের ‘মুক্তভাবে’ রাজনীতি করার সুযোগ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার তো তাদের শেষ সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধই করেছিল। ক্ষমতার পালাবদলে মাত্র এক মাসের মধ্যে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যকার সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
এ টানাপড়েনের কারণ জানতে চাইলে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা দুটি পৃথক দল। জাতীয় প্রয়োজনে আমরা বহুদিন একসাথে ছিলাম। এখন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছেন, আমরা আমাদের কর্মসূচি নিয়ে জণগণের কাছে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “লক্ষ্য করবেন, আমরা কিন্তু কোনো দলকেই স্পেসিফিক টার্গেট করে কোনো কথা বলি না। আমরা কথা বলি নীতিগত। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, গত বছরের ৫ অগাস্টের পরিবর্তনের পর ৮ তারিখ আমরা ক’টা বন্ধু সংগঠন নিয়ে বসলাম।
“বললাম যে, ‘আমরা সবাই মজলুম ছিলাম, দেশবাসী মজলুম ছিল, ১৮ কোটি মানুষই মজলুম ছিল। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন; আসুন, সবাই মিলে আমরা একটা দায়িত্বশীল আচরণ করি। কিছু কাজের কথা উল্লেখ করে আমি বলেছিলাম, ‘এই এই কাজগুলো আমাদের করা উচিত হবে না’। আমরা এটিও বলেছিলাম যে, ‘এই কাজগুলো যদি বন্ধ করা যায়, তবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে হয়তো আপনারা ক্ষমতায় যেতে পারবেন’।”
তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু আর কারো সাথে এরকম দরবারে বসব না। আমরা আপনাদের পাশে থেকে বিরোধী দলের আসনে বসে প্রত্যেকটি ভাল কাজের আমরা একশতভাগ, ষোলআনা সহযোগিতা করে যাব। কিন্তু জাতির ক্ষতি হয়—এমন কিছু ধরা পড়লে আমরা আপনাদেরকে প্রথমে কানে কানে বলব, যদি আপনারা বদলায়ে যান, তাহলে আমাদের কাজ শেষ।
“আর যদি না বদলান, তাহলে আমরা রাস্তায় নামব। এটাই হবে আমাদের পলিসি। তবে আমরা অনুরোধ জানাই যেন, এগুলো যেন আমরা বন্ধ করি, বন্ধ হয়নি। যা প্রত্যাশা করেছিলাম তা বন্ধ হয়নি। না হওয়ার কারণে আমরা মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আমরা কারো নাম নিইনি।”
শফিকুর বলেন, “নাম নিয়ে মুখ খোলাকে যদি আপনি আপনার ওপর টেনে নিয়ে যান, তাহলে মনে হবে যে আপনি এটার উপযুক্ত। রাজনীতিতে এটা হবে, এটা মেনে নিতে হবে।
“রাজনীতিতে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা আমারও থাকতে হবে, আপনারও থাকতে হবে। এটাই বিউটি অব ডেমক্রেসি। অপরের মতটাকে রেসপেক্ট করতে হবে। শোনা লাগবে, উনি কী বলতে চান।”
যুক্তরাষ্ট্র সফরে মার্কিন প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল বলেন, “সেটি সিক্রেট।”
তবে ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের এক সমাবেশে জামায়াত আমির বক্তৃতা করবেন বলে জানান দলের যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়কারী নাকিবুর রহমান।
অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী প্রবাসীরাও উপস্থিত ছিলেন।