মেয়েটি আত্নহননে যেতে চায়নি

রুমানা নাওয়ার »

রাত যতো বাড়ে অধিরার কষ্ট ততো বাড়তে থাকে। কোনকিছুতে মনকে প্রবোধ দিতে পাওে না সে। কেন এমন হলো তার জীবন। কেন তার সুখের সময়টাকে এরকম দূর্বিসহ করে তুললো তারা। সজীবকে তো ভালোই মনে হয়েছিল। তাহলে সে কীভাবে এসব বলে। একজন শিক্ষিত ভালো চাকুরে হয়ে তার এসবে কীভাবে রুচি হয়। বাবার করুণ চেহারাটা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো অধিরার। আহারে আমার দুঃখিনী বাবা।সারাজীবন ব্যয় করেছেন আমাদের ভালো কিছু হবে, ভবিষ্যতটা উজ্জ্বল হবে. এই ভেবেভেবে। কিন্তু সেটা আর হলো কই। সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন শেষ করে দিলো। আবার এখন নতুন হুজ্জোৎ। কীভাবে সামলাবে বাবা। অধিরা কিছুই বুঝতে পাওে না। তার সামনে শুধুই অন্ধকার। কোনো আলোর কিনারায় পৌঁছায় না অধিরার ভাবনাগুলো।
ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী অধিরা তাবাস্সুম । পটিয়া সরকারি কলেজে পড়ে। সুন্দরী, কোমল নরম স্বভাবের অধিরা সবার প্রিয়। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ছোটখাটো একটা দোকান চালায়। রোজগারের চেয়ে খরট বেশি। তবুও একটা কিছু নিয়ে পড়ে থাকা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখতেই অধিরার জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে ঘনঘন। পরপর তিনটা মেয়ে তাই বাবাও দেখেশুনে একটা প্রস্তাবে রাজী হয়। ছেলে পাশের গ্রামের। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত। দেখতে শুনতেও  ভালো। দিনক্ষণ ঠিক হলো। শর্ত দিলো বরযাত্রী খাওয়াতে হবে ৫০০ আর ঘরের যাবতীয় আসবাব টিভি ফ্রিজ  দিতে হবে। উপায় কী কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার। ধারদেনা করে বিয়েতে নামতে প্রস্তুত হলো। কিন্তু বিধিবাম। বিয়ের একদিন আগে ছেলে দাবী করে বসলো নগদ দুলাখ টাকাও দিতে হবে।নতুবা বিয়েটা হবে না।
অধিরাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো ছেলে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কী করবে অধিরা। অনেক অনুনয় বিনয় করলো—
প্লিজ, এতটা নির্দয় হবেন না আপনারা। আমাদের সামর্থ্যে কুলাবে না। আমার বাবা যেটুকুতে রাজী হয়েছে। সেটাই যোগান দিতে তার গলদঘর্ম হচ্ছে। আর কষ্ট দিবেন না বাবাকে। আপনি তো ভালো চাকরি করেন। তাহলে এত টাকার লোভ কেন আপনার? আতাউরের ইগোতে লাগলো কথাটা। আরও বেশী চাপ দিতে লাগলো নগদ টাকার ব্যাপারে।
বলেই দিলো সাফ সাফ—- টাকাটা না হলে আমি বিয়েটা করতে পারবো না। তোমার বাবাকে কথাটা জানিয়ে দিও।
বাড়ি ভর্তি অতিথি। অধিরার দুহাত ভরা মেহেদি। গায়ে হলুদের আভায় উজ্জ্বল দ্যুতি তার শরীরে চেহারায়। অধিরা কী করবে বুঝতে পারলো না। রাত পোহালে বিয়ে। আর আজ এ মুহূর্তে আতাউরের কী কঠিন বার্ত?। অধিরার হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। কাউকে কিছু বুঝতে দিলো না। রাত যতোই বাড়তে থাকে অধিরা নিজেকে একা করে ফেলে। বাড়িতে আগত অতিথিরা ঘুমিয়ে পড়লে কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ে উ™£ান্ত অধিরা।

অচেনা আগন্তুক,
আপনি প্রথম যেদিন আমায় দেখতে আসলেন সেদিন থেকে আপনাকে অদ্ভুত ভালো লাগতে শুরু করে। স্বপ্নও বুনতে শুরু করি। কত স্বপ্ন আমার। আপনাকে ঘিরে। দুজন মিলে একটা যুথবদ্ধ জীবনের খোঁজ পেলাম, ঘ্রাণ পেলাম যেন। কত সুখ. কত স্বপ্ন বুকের ভিতর অজানা এক ভালোলাগা। নতুন এক জীবনে আমি আপনি।  আমাদের প্রতিটি ভোর কতোটা মনোময় – আমার ভাবনায়। ঘোরলাগা এক সময় পার করছিলাম এ কয়দিন। আগে কি  আমার এমন হয়েছিল? কখনো না। এরকম স্বপ্নতাড়িত ছিলাম না আমি। সেই আমি কী রকম বদলে গেলাম। বিয়েটা একটা প্রক্রিয়া। যেখানে একটা পরিপূর্ণ বয়সের ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই গাট বাঁধে সারাটা জীবন একসাথে থাকবে বলে। বাবা-মার পছন্দ করা পাত্রটি তখন সেরা মানুষ তার চোখে। কিন্ত এক লহমায় সেটা ভেঙে দিলেন আপনি। কী ক্ষতি হতো আপনার এমন মনোভাবে। দুলাখ টাকাই তো। মাত্র দু লাখ। এটা একবারও মনে করলেন না যে. এ টাকার ভার আমার গরিব বাবার জন্য কতোটা দূর্বিসহ। আপনার সব চাহিদাই মেনে নিয়েছিল বাবা। তাহলে আবার কেন এ বোঝা চাপিয়ে দিলেন তার কাঁধে। কী ক্ষতি করেছিলাম আমি?
আমার জীবনটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিলেন। আমি এ বোঝা বইতে পারলাম না আর। আমায় ক্ষমা করবেন। পৃথিবীটা খুব সুন্দর। কিন্তু পৃথিবীর মানুষগুলো বড়োই  নিষ্ঠুর। তাই এখানে থাকা হলো না আর। বিদায়, পৃথিবী বিদায়। এখানকার মানুষ বিদায়। পৃথিবীর ফুল-পাখি-নদী জল।
ইতি
স্বপ্নতাড়িত অধিরা

চিঠিটা শেষ করে খানিক সময় নিল অধিরা। হুহু করে কাঁদলো মন খুলে। বাবা মা ভাইবোনদের জন্য মনটা কেমন করে উঠলো। তারপরই দাঁড়িয়ে ফ্যনের সাথে লাগানো রশিটায় ঝুলে পড়লো। আস্তে করে পা দিয়ে টুলটা  সরিয়ে দিলো। মূহূর্তেই অন্ধকার হয়ে আসলো পুরো পৃথিবী। শেষ নিঃশ্বাসটুকু বের হয়ে যাওয়ার সময়ে প্রচণ্ডভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করলো অধিরার। ঝুলে থাকা দুপায়ে প্রাণান্ত খুঁজলো ফেলে দেওয়া কাঠের টুলটিকে।