নিজস্ব প্রতিবেদক »
গাছের ভেঙে পড়া ডালের সাথে ধাক্কা লেগে বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনের ছাদে বসা ২০ শিক্ষার্থী আহতের ঘটনায় চবি ক্যাম্পাসে বৃহস্পতিবার রাত থেকে চবিতে মৃত্যুর গুজব রটিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। ১ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে একই ট্রেনে ক্যাম্পাসে ফিরে বাকি শিক্ষার্থীরা মূল ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ ভাঙচুরে রূপ নেয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি ভিসি বাংলো, শিক্ষক ক্লাব, পরিবহন পুল, পুলিশ বক্স।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪ টায় ক্যাম্পাস থেকে শহরগামী শাটলে। শাটলের ছাদে বসা লোক প্রশাসন বিভাগের ২১-২২ সেশনের কিবরিয়া নামের এক ছাত্র ঝুলে থাকা গাছের ডালের আঘাতে মারাত্মক আহত হন। তার মাথা ফাটা রক্তাক্ত ছবি স্যোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
সালাহ উদ্দিন আরফান নামের এক ছাত্র বলেন,‘মাথা ফাটানোর পর ষোলশহর স্টেশন মাস্টার এবং লোকমাস্টারকে চৌধুরী হাট স্টেশন সংলগ্ন ‘ভূতূড়ে গাছটার’ ব্যাপারে আমি মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছিলাম। ওনারা আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এর মধ্যে বেশ কিছু সময় কেটে যায়। রাত সাড়ে ৮টায় বটতলী রেলস্টেশন থেকে রওনা দেয় রাতের শেষ শাটল। চৌধুরীহাট স্টেশনে এসেই ফের ঘটে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অন্ধকারে শাটলের ছাদে এ ঘটনা ঘটার বিষয়ে শাটলের ভিতরে থাকা ছাত্ররা জানতে পারেননি। এর মধ্যে চৌধুরীহাটের ঘটনাস্থলে অংসইনু মারমা নামের লোক প্রশাসনের আরেক ছাত্রের অজ্ঞান অবস্থার ছবি স্যোসাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন ঐ এলাকার লোকজন। এই ছবিটি ছড়িয়ে গেলে এবং রাতের ট্রেন ক্যাম্পাস পৌঁছানোর পরে আহত বাকি ছাত্রদেরও নামানো হয় ছাদ থেকে। অজ্ঞান ছবির ছাত্রটিকে মৃত হিসেবে রটানো হয় গুজব। ছাত্ররা ফেটে পড়েন ক্ষোভে। অবস্থান নেন জিরো পয়েন্ট এলাকায়। তালা দেন মূল ফটকে। আগুন জ্বালিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানান তারা।
এ সময় তারা শাটলের বগি বাড়ানো, বাস সার্ভিস চালু, ট্রেনের শিডিউল বাড়ানো, শাটলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
ছাত্রদের মতে, শাটলের মধ্যে ব্যাপক ভিড় হওয়ায় পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে শাটলের ছাদে চড়তে হয়। দীর্ঘদিন ধরে শাটলের বগি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঘটনার বিষয়ে চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার বলেন,‘শাটলের ব্যাপারে রেলওয়েকে বলতে বলতে আমরা শেষ। এমনকি রেল মন্ত্রী আমাদের গতবছরই বলেছিলেন ট্রেন দিবেন, কিন্তু আমরা পাইনি। তারা বলেছেন তারা চেষ্টা করছেন আরও ২ , ৩টা বগি বাড়ানোর।’
জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে থাকা পুলিশ বক্স ভাঙচুর শুরু করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। এ সময় তারা সেখানে থাকা চেয়ার টেবিল টেনে আগুনে ছুড়তে থাকেন।
ভাঙচুরের বিষয়ে চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘ আমি খবর পেয়েছি ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টায় আমি এসপি সাহেবকে ফোন দেই। তিনি আমাকে বলেছেন ওনারা রওনা হচ্ছেন। তারপর ১১ টার দিকে আবারো ফোন দেই। তারা বললেন তারা পথে আছে। তারপর রাত ১২টার মধ্যে তিনি আমাকে জানান, সেখানে র্যাবও রয়েছে, ওনারাও রয়েছেন। আমি এবং দায়িত্বরত অনেকে তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে পর্যাপ্ত আইসিইউ ছিলোনা। তাই দ্রুত তাদেরকে প্রাইভেট হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করলাম।’
এদিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত হননি, তারা ক্রমে এগুতে থাকে উপাচার্যের বাংলোর দিকে। সেখানে গার্ডসহ বেশ কয়েকজনের সাথে হাতাহাতি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তা বলয় ভেঙে এক পযার্য়ে তারা ঢুকে পড়ে বাংলোর ভিতরে। সেসময় সেখানে উপাচার্য ছিলেন না। কিন্তু দরজার সামনের মাটির ফুলের টব থেকে বাথরুমের বেসিনের আয়না কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে। লুটপাট হয়েছে ভিসি বাংলোর ফ্রিজের মাংসও। এছাড়া ভাঙচুর হয়েছে আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, দরজা,জানালা।
ভাঙচুর থেকে রক্ষা পায়নি পরিবহন দপ্তরের পরিবহন লুপে থাকা একটি গাড়িও। সেখানে শিক্ষকদের ২৪টি বাস, ১৫টি মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার এবং ১টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন ছাত্র বলেন,‘যারা ভাঙচুরে অংশ নিচ্ছিলেন, তারা বাকি ছাত্রদের বলছিলেন ভিডিও না করতে এবং নিজেদের মুখও কাপড়ে ঢেকে ফেলেন তারা।’
এরপর তারা এগিয়ে যায় শিক্ষক ক্লাবের দিকে। সেখানে সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রোকন উদ্দিনসহ আটকা পড়েন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। বাইরে পার্কিংয়ে থাকা প্রক্টরের গাড়ি , শিক্ষকদের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি ,ভবনের গ্লাস, দরজা ,জানালা ভাঙচুর করা হয়।
এ ব্যাপারে সহকারী প্রক্টর রোকন উদ্দিন বলেন,‘ আমরা চবি ক্লাবে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ করে আমাদের উপর হামলা হতে শুরু করে। আমরা পুরো প্রক্টরিয়াল বডি কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যাই। এরপরও তারা আমাদের আবদ্ধ করে রাখে অনেক সময়। এটা এটেম্প টু মার্ডার।’
ঘটনার বরাত দিয়ে চমেকে কর্তব্যরত আশেক নামে এক পুলিশ সদস্য জানান,রাত ১টার দিকে বিক্ষুব্ধরা মূল ফটকে অবস্থান নেন। ততক্ষণে নিশ্চিত হওয়া যায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। রাত ২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেসময় ক্যাম্পাসে এসে উপস্থিত হন উপাচার্য। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক সমিতির নেতারা।
এদিকে ঘটনার পরদিন গতকাল সকালে রাতের ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘সে সময় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কেউই কোনো বাধা দেয়নি। কোনো পদক্ষেপ নেননি। যার ফলে র্নিবিঘেœ ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত টানা ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। ’
এ দিকে এ নিয়ে শুক্রবার বিকেল ৪টায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিনা এই অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের ২ শ’ ৩ শ’ ছাত্র এত দা ছুরি কিরিচ কোথা থেকে পেলো। এগুলো কোনোভাবেই ছাত্র সুলভ আচরণ নয়। তারা গার্ডদের মারধর করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ভাঙচুর করেছে, প্রক্টরদের মারার চেষ্টা করেছে। ইতোমধ্যে ৩টি মামলা হয়েছে। আমাকে মারার জন্যেও তারা ভিসি বাংলোর দিকে হামলা করেছে। এখানে হত্যাচেষ্টার মামলা হবে। এছাড়া ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনার পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আরও মামলা হবে। ’
এদিকে শাটল ট্রেনের ছাদে গাছের ডালের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি আছেন আমজাদ হোসেন সোহাগ, বাংলা বিভাগের ছাত্র খলিলুর রহমান, লোক-প্রশাসন বিভাগের অংসইনু মারমা (২১) নামের ৩ছাত্র।
এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিক্যালের ২৮নম্বর নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের তাজুল ইসলাম (২১), বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের আবু সাঈদ (২৪), ইংরেজি বিভাগের মোহাম্মদ সান (২১), নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের রাফসান (২৩) এবং আসলাম (২২) নামের এক ছাত্র। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।