সুপ্রভাত ডেস্ক »
ডলার সংকট, আমদানিতে কড়াকড়ি আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবার এক সঙ্গে জেঁকে বসেছে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল আমদানির ওপর। বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। গত দুই মাসে দুই মাসের এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তিতে তা ফুটে উঠেছে।
দুই মাসে যথাক্রমে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৩৮১ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৮৮ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলারের। দুই মাসে এলসি খোলা কমেছে যথাক্রমে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। খবর বাংলানিউজ। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্র বন্দর থেকে ছাড়করণ কমেছে ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে ছাড় হয়েছে ৪৯০ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর আগের বছরের একই সময়ে বন্দর থেকে ছাড় হয়েছিল ৭৫২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার।
শিল্পায়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমে যাওয়ার এ চিত্র আগামীতে শিল্পায়নের গতি কেমন হবে তা নির্দেশ করছে। শিল্পায়নের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি চিত্রতেও এ ছাপ ফুটে উঠেছে। ডলার সংকট ও সামনে নির্বাচনের কারণে নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। আর এ কারণে উদ্যোক্তারা নতুন করে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল আমদানি করছেন না। এমনকি আগে আমদানি করার জন্য এলসি খুলেছিল সেগুলো নিষ্পত্তির গতি কমে গেছে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ করে লাভের প্রত্যাশা কমে গেলে নতুন করে বিনিয়োগ করে না। গত এক বছর ধরে ডলার সংকট। আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা হয়েছে। এতে আমদানি কমে আসছিল। নির্বাচনকে সামনে করে পরিস্থিতি অনিশ্চয়তা বেড়েছে। মূলত দুটি কারণে এলসি খোলা কমেছে বলে মনে করি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর কাছে ছেড়ে দেওয়ার পর ভিন্ন দর থেকে এক দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা এসেছে। তারপরও পুরোপুরি বাজারের হাতে যেতে পারেনি। ১০৯ টাকা করে কিনে ১১০ টাকায় বিক্রি করবে, এটা হচ্ছে না। ফলে ডলারের যে সংকট তা দিন দিন বাড়ছে। এর প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়েও। আগের চেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে গেলেও কমছে প্রবাসী আয়।
দুই মাসে উৎপাদনের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর বন্দর থেকে ছাড় হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা ও বন্দর থেকে ছাড় কমেছে ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে খাদ্য নিরাপত্তাকে শিল্প খাতের উৎপাদন সহায়ক এসব পণ্যের আমদানি কমার পাশাপাশি পেট্রোলিয়াম আমদানিতে পড়েছে। জুলাই -আগস্ট দুই মাসে পেট্রোলিয়াম আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর বন্দর থেকে পেট্রোলিয়াম ছাড় কমেছে আরও বেশি; কমার এ হার ২৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চতায় উদ্যোক্তারা উৎকণ্ঠায় আছেন। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ তো দূরে থাক, চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চিন্তিত। এজন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমছে- বলে জানালেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি ও এফসিসিআইয়ের পরিচালক হাবিবুল্লা ডন।
তিনি বলেন, দেড় বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এ সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তারা সংকটকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে আমদানিকারকদের কাছে থেকে থেকে ডলারের বাড়তি দাম আদায় করছে। ডলারের বেঁধে দেওয়া রেটের চেয়ে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি নিয়েছে। ব্যাংকের এ অনৈতিক লেনদেনের চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়েছে। বেশি মুনাফার করার দায়ে ১০ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এতে বোঝা যায় কেন কেন মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। প্রবাসী আয়ে ভাটা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়াতে আরও প্রলম্বিত করছে। জরুরি ছাড়া মানুষ কমিয়ে কেনাকাটা দিয়েছে। কমে গেছে গাড়ি কেনা, একই অবস্থা চলছে ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও।
খাদ্য, বস্ত্রের বাইরে অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ নেই। এ প্রভাব পড়েছে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ও কাঁচামালে আমদানি। এ পরিস্থিতি আগামী বছরের জুন পর্যন্ত চলমান থাকবে বলে মনে করছেন এই উদ্যোক্তা নেতা। হাবিবুল্লা ডন বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে দুটি পথ। প্রথমত, যে কোনোভাবেই হোক প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া। প্রয়োজনে প্রণোদনা আরও এক শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া, যারা অবৈধভাবে বিদেশে গেছে তারা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের টাকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা গেলে বৈধপথে প্রত্যাশিত প্রবাসী আয় আসবে। এতে ডলারের সংকট দূর হবে। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে রাজনৈতিক সংঘাত যাতে তৈরি না হয় এবং অনিশ্চয়তা যা আরও ঘনীভূত না হয়, এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোতে সচেষ্ট হতে হবে।