মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়লে যা হবে

সুপ্রভাত ডেস্ক  »

দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। এটি ভোগাচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। নানান পদক্ষেপের সঙ্গে সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এরই মধ্যে নীতি সুদহার (রেপো সুদ) আরেক দফা বাড়াতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে আসতে পারে এ ঘোষণা।

এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয় বলে মত উদ্যোক্তাদের। আর সুদহার বাড়িয়ে বিনিয়োগ চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে সারাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোগ বড় রকমের চাপের মধ্যে পড়েছে। দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন হতাশ। তারা তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেন তারা, সামনের দিন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না এটা নিয়েও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। এসব ব্যবসার সঙ্গে নির্ভরশীল পরিবারগুলোও বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। হতাশা রয়েছে মাঝারিসহ অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যেও।

অপরদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম চার মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এই হার সর্বনিম্ন। এ সময়ে শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ঋণপত্রের নিষ্পত্তি কম হয়েছে। খবর জাগোনিউজ।

ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনী ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এ সবকিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছর যা ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি, কেবল কোভিড-১৯ এর ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি মাস জানুয়ারির শেষভাগে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। নতুন গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা এটি। এরই মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ মাসে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট করে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বর্তমানে যা ১০ শতাংশ। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এতে বাজারে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে এসেছে। ফলে অর্থনীতিতে যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হতে পারে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আসছে মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে, শিগগির বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সম্ভব নয়। যেসব দেশের ৯০ শতাংশই ভোক্তাঋণ, সেখানে এটা নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও আমাদের এখানে অকার্যকর হবে। উন্নত বিশ্বে বাড়ি, গাড়িসহ নানান কাজে ঋণ নেন ভোক্তারা, সেখানে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। আর আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেন উদ্যোক্তারা। সুদহার এখন ১৫ শতাংশ। এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে ঠেকেছে। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না, এতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও সর্বনিম্ন অবস্থায়।

এ বিষয়ে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত ঋণ নিয়েই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন। সুদ যখন বাড়ে, এতে প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে বড়রাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন চালের গোডাউনে দেড় মাস চাল রেখে বিক্রি করতে সময় লাগে, চাতালসহ বিভিন্ন খচর আছে। এক্ষেত্রে সুদহার বাড়লে এভাবে সব ক্ষেত্রে প্রভাব বাড়বে। খরচ দেবে ভোক্তা।’

ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম বলেন, ‘সুদহার বাড়িয়ে কী অর্জন করতে চায় এটা বুঝি না। উন্নত বিশ্ব সুদহার না বাড়িয়ে একটা জায়গায় রাখতে চায়। আবার বাড়ালেও এর সাইড ইফেক্ট আছে, সেটা দেশ নিতে পারে না। একটা স্থবির দিকে যায়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। এখন ব্যাংকে রাখলে যদি ১৫ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে কি ব্যবসা করবে কেউ? ওটা তো নিরাপদ বিনিয়োগ, ব্যবসা করলে লাভ-লোকসান আছে। আমি তো ব্যবসা না করে ব্যাংকে রাখতে চাইবো। এতে নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে না, ব্যবসা কমবে।