নিজস্ব প্রতিবেদক »
সব পাখি ঘরে ফিরে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। মিনু আক্তাা জীবনের সব লেনদেন শেষ না করতেই ফিরতে হলো না ফেরার দেশে। জেল জীবনেই বাইরের অনেক লেনদেন প্রকৃতির নিয়মেই সমাপ্ত হয়েছে।
মিনু আক্তার তিন সন্তানকে নিয়ে মা ও ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। জীবন চালাতে কখনো মানুষের বাসায় কাজ করেছেন, কখনো ভিক্ষা করেছেন পেটের দায়ে। ছোটভাই রুবেল রিকশা চালাতেন। তারা দুই ভাই বোনের স্বল্প আয়ে টানাটানি করে সংসার চলতো। স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ায় শেষ ঠিকানা হয়ে উঠে বাবার বাড়ি।
হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায় মিনু। ২০১৮ সালের ১২ জুন থেকে পরিবারের কেউ তার খোঁজ পায়নি। নিখোঁজের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন তার মা ছালেহা বেগম। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ভাই রুবেল। এদিকে সংসারের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়! সংসারের বোঝা আর বহন করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে আদরের তিন বছরের ভাগনিকে দত্তক দেয় পাশের বাসার এক দম্পতিকে।
এদিকে দুই ভাগিনা মো. ইয়াসিন (১২) ও মো. গোলাপ হোসেনকে (৯) নিয়ে চলছে রুবেলের জীবন। হঠাৎ একদিন খবর আসলো মিনু জেলে। তার অপরাধ পোশাক শ্রমিককে হত্যা। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রুবেল।
সারাদিন রিকশা চালনার জন্য বাইরে থাকায় ভাগিনাদের দেখাশোনা ও সংসারের হাল ধরতে বিয়ে করেন রুবেল। একদিকে অভাবের তাড়না অন্যদিকে দুই ভাগিনার দায়িত্ব। রুবেলের জীবনে এক কঠিন পরিস্থিতি নেমে আসে। বড় ভাগিনা ইয়াসিনকে স্কুলেও পাঠাতে পারেনি। অভাবের কারণে কাজে লাগাতে হলো ইয়াসিনকে। দুই নম্বার গেইট এলাকায় চায়ের দোকানে কাজ করতে শুরু করে। অন্যদিকে শিশুসন্তান গোলাপকে ভর্তি করানো হয় হযরত ইমাম হোসাইন এতিমখানায়। এতে তার পড়া লেখার জন্য কোন খরচ দিতে না হলেও দিতে হচ্ছে তার নিত্যদিনের খরচ।
মাদ্রাসার স্বত্বাধিকারী রাসেল হোসাইন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমার মাদ্রাসায় গোলাপের মত আরো ১২ জন ছাত্র রয়েছে। তবে এ মাদ্রাসায় পড়ালেখা ও খাওয়া খরচ বিনামূল্যে হলেও বইপত্র তো নিজে থেকে কিনতে হয়। গোলাপের এসব খরচ আমি বহন করি। তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাকে দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছে বলে জানান তিনি।’
নিরপরাধ মিনু তিন বছর ৪ দিন পরে ১৬ জুন কারামুক্ত হলেন। জেল গেইটে তাকে নিতে এসেছিলেন ভাই রুবেল। জেল গেইটে শুনতে পায় ১৫ এপ্রিল দুর্ঘটনাবশত মেয়ে জান্নাতের মৃত্যু হয়েছে। কারামুক্ত হয়ে ভাইয়ের ঘরে ফিরেন মিনু।
গত ২৮ জুন সকালে মিনু বেগম ঘর থেকে বের হয়। সারাদিন জঙ্গল সলিমপুর এলাকার গোলাপের দোকানে হাঁটাহাটি করেন। রাতের দিকে চলে যান বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে। এদিকে ভাই রুবেল ভেবেছেন এলাকাবাসী সবাই পরিচিত হওয়ার কারণে কারো ঘরে গিয়ে বসে আছে। পরদিন সকাল থেকে তাকে খোঁজাখুজি শুরু হয়। কিন্তু কোথা মিলেনি মিনুর সন্ধান। তিনি আবারো নিরুদ্দেশ হলেন। ৩ জুলাই বিকেলে রুবেলের কাছে পুলিশের এক কর্মকর্তা এসে ছবি দেখালে তিনি তার বোনের ছবি শনাক্ত করেন। পুলিশ জানান তিনি ২৮ তারিখ দিবাগত রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাকে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম কর্তৃক দাফন করা হয়েছে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘মিনু আক্তারের মৃত্যুতে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত ড্রাইভারের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু হয়েছে। এ মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।’
রুবেল বলেন, জেলে যাবার আগে আমার বোন ভাল ছিল। কিন্তু খুনের মামলায় তিনি জেলে যাওয়ায় তাকে হয়তো বেশি কষ্ট দিয়েছে। জেল থেকে এসে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।’
এলাকাবাসী বলছেন, ‘মিনু জেলে যাওয়ার পরে তাদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রুবেল একা পুরো সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছে। তবে এখনো তারা স্বচ্ছল নয়।’
উল্লেখ্য, মুঠোফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরের রহমতগঞ্জ এলাকার একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর এই মামলার রায়ে কুলসুমা আক্তারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। প্রকৃত আসামি কুলসুমা আক্তার মামলার সাজা হওয়ার আগে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সাজা হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমা সেজে মিনু কারাগারে আসেন। মর্জিনা আক্তার নামের পূর্বপরিচিত এক নারী তাকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চিনতেন না। কিন্তু ভয়ে কাউকে কিছু বলেননি বলে জানিয়েছিলেন মিনু।