হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই সকল প্রশংসার মূল মালিক, যাঁর সৃষ্টি জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজ¯্র প্রশংসনীয়, মোহনীয় বস্তু। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি ভালবাসেন পবিত্র বান্দাদেরকে। তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি তাঁর হাবীব (দ.) কে একান্ত নৈকট্যে ধন্য করেছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া উপাস্য নেই। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের পথদ্রষ্টা, কর্ণধার হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও শ্রেষ্ঠতম রাসূল। তাঁরই উম্মত হতে পেরে আমরা ধন্য।
আল্লাহ্র রাসূলের মু’জিযার অন্ত নেই, হিসাব নেই। তাঁর নবুওয়ত’র ব্যাপ্তি মহা প্রলয় অবধি; বরং অনন্তকালব্যাপি। উম্মতের আউলিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রকাশিত কারামতসমূহ মূলত তাঁরই পরোক্ষ মু’জিযা। তাঁর সব মু’জিযার মধ্যে প্রত্যক্ষ ও স্থায়ী মু’জিযা পবিত্র কুরআন। তাঁর সবচেয়ে বড় মু’জিযা মহান ¯্রষ্টার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ। মাহে রজবেই সংঘটিত হয় মহান এ মু’জিযা। মু’জিযা বা আল্লাহ্র নবীর অলৌকিক ক্ষমতায় আপত্তি করে থাকে কপট বিশ্বাসী মুনাফিকরা। সরল বিশ্বাসী খাঁটি মুমিন মু’জিযায় সন্দেহ করতে পারে না। তাঁরা বিশ্বাস করেন মু’জিযা নবীর বৈশিষ্ট্য। যেহেতু নবুওয়ত, বেলায়ত আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ নে’মাত। নবীÑরাসূলগণের মু’জিযা ও আওলিয়ায়ে কেরামের কারামত আল্লাহ্ প্রদত্ত। আর কুদরত আল্লাহ্ তাআলার সত্তাগত। অসংখ্য মু’জিযার মধ্যে মে’রাজুন্নবীও প্রিয়নবীর অভূতপূর্ব মু’জিযা। প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘পবিত্র সে মহান সত্তা, যিনি রাতের এক ক্ষুদ্র অংশে নিজ প্রিয়তম বান্দাকে নিশি ভ্রমণে নিয়ে যান মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায়, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি। তা এ কারণে যে, তাঁকে আমি দেখাবো আমার কুদরতের নিদর্শনাদি। নিঃসন্দেহে তিনি শোনেন, তিনি দেখেন’। (১৭:১)
সুরা বনী ইসরাঈল’র প্রথম আয়াত’র অনূদিত বক্তব্য উপরে বর্ণিত হল। সুরাটির আরো নাম রয়েছে। যথা ‘ইসরা’। কারণ, ‘আসরা’ ক্রিয়াপদে সুরাটি আরম্ভ হয়, যার ক্রিয়ামূল ইসরা। তাই এ নামকরণ। আরেক নাম সুরা ‘সুবহান’। আল্লাহ্র এ নাম সুরার সর্বপ্রথম শব্দ। এ কারণে এটি সুরা সুবহান। (সূত্র : খাযা-ইনুল ইরফান) এ আয়াতে পবিত্র মে’রাজুন্নবীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সুস্পষ্ট বচনে আংশিক, আর ইঙ্গিতধর্মী বচনে চূড়ান্ত বর্ণনা বিদ্যমান। তবে, খাজা নিযামুদ্দীন দেহ্লভী (রহ.)র বরাতে গায্যালিয়ে যমান আল্লামা সায়্যিদ আহমদ সাঈদ কাযেমী (রহ.) লিখেছেন, মাসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্সা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ বলা হয়। এরপর আসমানী জগত পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘মিরাজ’ এবং সেখান থেকে চূড়ান্ত মনযিল ‘ক্বা-বা কাওসাইন’ পর্যন্ত ই’রাজ। এ স্তর বিশ্লেষক মহলের কাছে ‘লা-মকান’ বলে কথিত। বর্ণিত স্তরত্রয় একেকটি মানযিল। ঊর্ধ্ব যাত্রার একেক স্তর ভিন্ননামে দেখা যায়। যথা-ইসরা, মি’রাজ ও ই’রাজ। এ নামগুলো কুরআন ও হাদীসে এভাবে বর্ণিত। আর সামগ্রিকভাবে প্রিয়নবীর উর্ধ্বভ্রমণ বৃত্তান্ত সর্বসাধারণের কাছে যে নামে পরিচিত, তা হলো মি’রাজুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এদিক থেকে স্তরত্রয়ের সব ক’টিকে বেষ্টন করে শব্দটি।
মে’রাজের বর্ণনা দীর্ঘতর। সংক্ষিপ্তভাবে হলেও এ পর্যায়ে প্রথমত এর নেপথ্যের দু’-একটি রহস্য, তাৎপর্য বর্ণনাই আজকের আলোচ্য। নবীপ্রেমিক প্রথিতযশা লেখক, দার্শনিক ইসলামী মনীষীবৃন্দের আলোচনার নির্যাস হতে তত্ত্ব, উপাত্ত উপজীব্য করে এ লেখার প্রয়াস।
আমরা জানি এবং মানতেও বাধ্য যে, আল্লাহ্ তআলা তাঁর সত্তাগত গুণাবলী নিয়ে তুলনার ঊর্ধ্বে। তিনি ¯্রষ্টা, বাকী সবকিছু সৃষ্টি। ¯্রষ্টার সাথে সৃষ্টির কোনোদিক তুলনা করা শির্ক। সৃষ্টির সব গুণাগুণ মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ্ প্রদত্ত। তিনি যাঁকে ইচ্ছা, যেমন ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাঁকে যেমন ইচ্ছা, নিজ অনুগ্রহে ধন্য করেন। ‘যা-লিকা ফাদ্বলুল্লাহ্, ইউ-ত্বীহি মাইঁ ইয়াশা’। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি যত মর্যাদা তাঁর হাবীব, আমাদের হাদী মাহ্দী সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দান করেছেন, তেমনি দ্বিতীয় কাউকে দেন নি। আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, ‘আমি রাসূলগণের মধ্যে একজনকে অপরের ওপর ‘ফযীলত’ (মর্যাদা) দান করেছি। তন্মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ্ বাক্য বিনিময় করেছেন। আর তাঁদের কেউ এমনও আছেন, যাঁকে তিনি প্রভূত মর্যাদায় সবার ওপরে সমুন্নত করেছেন’। (সুরা বাক্বারা : আয়াত-২৫৩) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে, তিনি হলেন নবীযে আখের-যমান, মেহমানে লাÑমকান, রহমতে দোজাহান, সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর অতুলনীয় মর্যাদাসমূহের মধ্যে সমুজ্জ্বল হল মে’রাজ শরীফ।
উচ্চ মর্যাদায় আসমানী জগৎ পরিভ্রমণের কথা আরেকজন নবীর প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ হয়েছে, তিনি হযরত ইদরীস (আ.)। তবে ওই উর্ধ্বলোক বিহার চতুর্থ আসমান পর্যন্ত। আমাদের প্রিয়নবী এমন উচ্চতায় উন্নীত হন, যেখানে ফেরেশতাÑসর্দার জিবরাঈল (আ.) ও যেতে সাহস করেননি। আল্লাহ্র সাথে কথাবার্তা বলার কারণে মুসা (আ.)র লক্বব কালীমুল্লাহ। কিন্তু সেখানেও দৃষ্টির অন্তরালে। আর আল্লাহ্র হাবীব (দ.) কে আল্লাহ্ সর্বোচ্চ পরিম-লও ছাড়িয়ে যেখানে ‘মকান’ বা স্থানিক সীমারেখা অচল, সেই ‘লা মকান’-এ একান্ত সাহচর্যে নিয়ে ধন্য করেন। যার ফলে তিনি আল্লাহ্র কালাম শোনেন, তাঁর ঐশী জ্যোতিও প্রত্যক্ষ করেন। এ জন্য পবিত্র কুরআনের ভাষায় তিনি ‘সামীউন’ (শ্রোতা) ও ‘বাসীরুন’ (দ্রষ্টা)
আর যে সমস্ত বিশেষ মর্যাদা অন্য পয়গরম্বরগণ লাভ করেছেন, তার প্রত্যেকটি মহান প্রভু নিজ হাবীবের মধ্যে পুঞ্জিভূত করেন। ইবরাহীম (আ.)র জন্য নমরূদের আগুন শীতল করেন। এদিকে তিনি (দ.) যে রুমালে পবিত্র হাত মুছেন, পরে সেটি আগুনে ফেলে দিলেও পুড়েনি। ঈসা (আ.) মৃতকে জীবিত করতেন, আর মে’রাজওয়ালা নবীজির আহ্বানে হযরত জাবের (রাদ্বি.)’র মৃত সন্তানদ্বয় জীবিত হয়ে তাঁর সাথে ভোজে অংশ নেন। (শরহে বুরদা খরপূতী দ্র.) হযরত মুসা (আ.)’র মু’জিযাধর লাঠির আঘাতে পাথর দীর্ণ হয়ে পানি নির্গত হয়। আর নবীজির আঙ্গুল মুবারক হতে মরুর বুকে পানির ফোয়ারা বয়ে যায়। মুসা কালীমুল্লাহ্ তূর পর্বতে গিয়ে আল্লাহ্র আলাপনে ধন্য হন। তাই, লা-মকানের মেহ্মান হাবীবুল্লাহ্ (দ.) কে মহান আল্লাহ্ তাঁর একান্ত নৈকট্যে এনে বাক্যালাপে ধন্য করেন।
উম্মতের নিকট অন্য নবী-রাসূলগণ আল্লাহ্র যাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলি)র সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য যথার্থ, পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রত্যক্ষকারীর সাক্ষ্য হতে হয়। তাই তাঁদের পক্ষে সৃষ্টির একজনকে সে পূর্ণসাক্ষ্য দাতারূপে বেছে নিয়ে কুদরতের মালিক সৃষ্টির কাছে তাঁর সাক্ষী সাব্যস্ত করেন শ্রেষ্ঠতম বান্দা ও রাসূল মে’রাজওয়ালা হাবীব (দ.) কে। এটাই বাস্তবতা যে, আল্লাহ্ তাঁকে ‘শাহেদ, শহীদ; নামে আখ্যায়িত করেন।
পবিত্র কুরআনে একস্থানে রয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মুমিনদের কাছ থেকে তাঁদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন। এর বিনিময় মূল্য তাঁদেরকে জান্নাত দেবেন’। (৯:১১১) এখানে আল্লাহ্ ক্রেতা, মুমিন বিক্রেতা। বিক্রেতা না ক্রেতা দেখেছেন, না বিনিময় মূল্য। এ লেনদেন কীভাবে শুদ্ধ হবে? উত্তর হলো, উভয়পক্ষের মধ্যে একজন প্রতিনিধিত্ব করবেন, যিনি উভয় দিক প্রত্যক্ষই দেখেন ও জানেন। মধ্যস্থতাকারী নবীজি প্রত্যক্ষ করেন। যাঁর চেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ততম সৃষ্টিতে কেউ নয়। এ জন্য চাক্ষুষ পরিদর্শনের ব্যবস্থা এ মি’রাজ।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।