কঙ্কন সরকার :
প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে ফিরল তারা। তাও মাসদেড়েকের জন্য। বেশ বড়ই হয়েছে পাপপু। ওখানকার কোনো এক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। তবে সুবিধে, ওই স্কুলে বাংলাও নাকি পড়ানো হয়। যাক, ভালোই হয়েছে যে, পাপপুর মাতৃভাষাটা চর্চার মধ্যে থাকে। ভালোই পারে ও বাংলা পড়তে ও বলতে। বুঝতেও কোনো সমস্যা হয় না কঠিন শব্দগুলোও। নাতিকে পেয়ে দাদু তো মহাখুশি। আর মিলও তার সঙ্গে বেশি। তাই তো পাপপু দাদুর সঙ্গে খাবে, বেড়াবে, গল্প করবে।
দাদুর ঘরে একটা ছবি টাঙানো আছে। গরুর গাড়িতে বউ যাওয়ার দৃশ্য। পাপপুর কেন জানি ছবিটার ওপর মন আটকে গেছে। আর এ ছবিতে ভর করেই চলে যায় তারা দাদুর ফেলে আসা দিনগুলোতে। দাদু বলে, জানো দাদুভাই, এই গাড়িই ছিল তখনকার দিনে বউ বাপের বাড়ি যাওয়ার উত্তম পন্থা। হেসে বলেন, তবে এটাতে একটা ভাবও প্রকাশ পেত। এই যে তোমরা বিমান থেকে নেমে এসি গাড়ি ভাড়া করে সোজা চলে এলে বাড়িতে, তেমনি তখন গরুর গাড়িই ছিল সে সময়ের দামি বাহন। একটু থেমে বলে, ঘোড়ার গাড়িও ছিল। তবে তা কিন্তু গরুর গাড়ির চেয়ে দ্রুত ছিল।
পাপপু বলল, দাদু এগুলোতে কী পেট্্রল, অকটেন …? এ বলে ঠোঁটে আঙুল চেপে কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। তারপর বলল, মনে করতে পারছি না। দাদু, এসবে কী লাগতো ওসব?
দাদু বলল, না না দাদুভাই, ওসব কেন এতে লাগবে? তখন ছিল একদম দূষণমুক্ত যানবাহন। ওহ হো হো, ছিল পালকি। এর নাম শোনোনি?
পাপপু যেন ভাবনায় পড়ে গেল। একটু পর বলল, না দাদু শুনিনি বোধ হয়।
দাদু বলল, বাক্সের মতো কাঠ দিয়ে বানানো হতো। নকশা করা হতো ওর চারপাশটা। মাঝে দরজা ছিল। মহিলাযাত্রী আর নতুন বউকে ওর মধ্যে বসিয়ে আনা-নেওয়া করা হতো।
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদু, টিভিতে দেখেছি। বলে পাপপু হাসল।
এই তো জানো বলে দাদু বলল, এটাতে কিন্তু চাকা ছিল না। ঘোড়া গরুও টানতো না। মানুষই কাঁধে করে নিয়ে যেত। যারা নিয়ে যেত তাদের চলার মধ্যে একটা শব্দের ঝংকার হতো। হেঁইয়ো হেই, হেঁইয়ো হেই, হেঁইয়ো হেই… । দাদু থেমে বলল, কী, মজার না! পাপপু হাসিভাব করে মাথা দোলালে। দাদু বলল, আর যারা নিয়ে যেত তাদের বলা হতো বেহারা।
বাঃ বেশ মজার তো! পাপপু বলল।
এর মাঝে পাপপুর মা চালের গুঁড়া জাতীয় কিছু নিয়ে এলো। বলল, তোমার মামি বানিয়েছে। দিতে দিতে বলল, পাপপু, দাদুসহ খাও। চামচও এগিয়ে দিল। দাদু তো বুঝতে পেরেছে। তো তিনি একটু খেয়ে পাপপুকেও খেতে বললেন।
পাপপু যেন অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে চামচে নিতে নিতে দাদুকে বলল, এটা কী দাদু!
দাদু আর একবার নিতে নিতে বলল, আগে খেয়ে দেখ দাদু! পাপপু মুখে দিল। নোনতা নোনতা স্বাদ, তবুও খেল। আর একবার নিতে নিতে দাদু বলল, এটার নাম ধুপি। এটি আলুর পাতা, মরিচ, রসুন, লবণ, ভাজা চাল মিশিয়ে ঢেঁকিতে গুঁড়া করতে হয়। পাপপু চিবানো বাদ দিয়ে বলল, ঢেঁকি!
ওহ্ হো হো করে হেসে দাদু বলল, ওটা বড় কাঠ দিয়ে বানানো হয়। মাথায় একটা বড় শলাকা থাকে। পিছনটা দুটো বাঁশের মধ্যে আটকানো থাকে। পা দিয়ে চাপ দিলে বেশ ওঠে-নামে। আর একটা কাঠের মধ্যে গর্তের মতো করে নিচে রেখে ওতে এসব দিয়ে চাপ দেওয়া হয় বারবার। এ বলে দাদু আর একবার মুখে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, তোমায় দেখিয়ে আনব এখন। তুমি খাও। থেমে বলল, কেন, ভালো লাগছে না? পাপপু শুধু মাথা দোলালো!
সকালে দাদুর সাথে পাপপুও বেরিয়ে পড়ল। শীতকালটা শেষের দিকে। দাদু চাদর পেঁচিয়ে নিয়েছে। হাঁটছে তারা। উদ্দেশ্য খেজুরের রস খেতে যাওয়া।
কিছু ছেলেমেয়ের একটা আগুনের স্তুপকে ঘিরে থাকতে দেখে পাপপু বলল, দাদু ওরা ওখানে কী করছে? দাদু বলল, চলো একটু ওখানটায় বসি। পাপপুকে সবাই দেখছে। দাদু হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাপপুকে বলল, দাও, হাত বাড়িয়ে দাও। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে। কেউ একজন আগুনটাতে খড় এনে দিয়ে একটু জ্বালিয়ে দিল। একটু গরম অনুভূত হলে পাপপু বলল, বেশ তো দাদু!
দাদু বলল, এর নাম পোড়্। আগে কাপড়ের খুব অভাব ছিল রে ভাই। তখন মানুষ শীত নিবারণের জন্য এরকম আগুনের কু-লী বানিয়ে বানিয়ে গা গরম করে নিত। আবার ধোঁয়া করে মশাও তাড়াত। এ বলে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা চলো, আবার চলতে শুরু করলো। সরিষার খেত দেখে থমকে দাঁড়ালো পাপপু। হলুদ ফুল দেখে বললÑ ওয়াও! কী সুন্দর! দাদুও দাঁড়াল। বলল, কী সুন্দর না দাদুভাই! অবাক হওয়া হাসি হেসে পাপপু বলল, ওয়ান্ডারফুল! তারপর বলল, দাদু এর কিছু ফুল নেওয়া যাবে না?
ঠিক আছে, ফিরবার সময় নেব কিছুটা। গন্তব্যে পৌঁছাল তারা। তখনও খেজুর গাছ থেকে রস নামানো হচ্ছে।
পাপপুকে দেখে রসবিক্রেতা দাদুকে বলল, বিদেশি নাতি নাকি?
হ বলে দাদু বলল, রস খাওয়াতে নিয়ে এলাম। রসবিক্রেতা খুশি হয়ে দিচ্ছি দিচ্ছি বলে একগ্লাস রস এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও দাদা, খাও। দাদুকেও দিল। দাদুর দেখে পাপপুও চুমুক দিলো। বেশ মিষ্টিস্বাদে মুখে হাসিভাব ফুটে উঠল ওর। বাকিটুকুও খেয়ে নিল। শুনে নিল কীভাবে খেজুর রস পাওয়া যায়।
রসওয়ালা বলল, তোমরা য্যাট্টে থাকেন স্যাট্টে এ্যাগলা নাই?
হয়তো পাপপু ভাষার টান বুঝতে পারেনি। তাই চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। দাদুই বলল, এ্যাগলা ওটে কটে পাইবে? এ বলে, পাপপুকে বলল, দাদুভাই সেখানে কী খেজুর গাছ আছে?
পাপপু মাথা নেড়ে না বোধকভাবে প্রকাশ করল। একটু দূরে গরুর লাঙল দিয়ে চাষ করছে একজন। পাপপু দেখে বলল, কী করছে দাদু ওখানে?
চলো বলে দাদু ওকে নিয়ে নিয়ে গেল সেখানে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল পাপপু। দুটো গরু সমানভাবে যাচ্ছে আর পিছে পিছে একটা বাঁকানো কিছু মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে যাচ্ছে। বেশ আশ্চর্য লাগছে ওর।
লাঙলওয়ালা বলল, কী, বৈদেশি দাদু নাকি? হ, বলে দাদু বলল, তোমার হাল দেওয়া দেখতে এলো। হাসি দিয়ে গরুকে লাঠি দিয়ে আস্তে আস্তে গুঁতো দিয়ে চাষি বলল, হেই যা যা …।
পাপপুকে বেশ লাগছে। হাসতে হাসতে বলল, আমিও অমন করতাম দাদু! দাদু হাসল। তারপর তারা চলল বাড়ির পথে। দাদু যেতে যেতে বলল, এর নাম হাল আর গরু দুটোকে বলে বলদ। তবে এখন আর তেমন নেই গরুর হাল। খুবই কম। ট্রাক্টর এসেছে যে।
পাপপু কী বুঝল বোঝা গেল না।
এভাবে শীতকালটা শেষ হয়ে বসন্ত এলো। নতুন হাওয়া বইছে চারদিকে। পাপপুও যেন বুঝতে পারল নতুন কিছুকে। কোকিলের ডাকটা তার খুব মনে ধরল। দাদু বলল, এ পাখি বসন্তের দূত। তো এই পাখি দেখবে পাপপু। অনেক চেষ্টার পর দেখা মিলল। পাপপু বলল, ওহ, ফাইন! ও কিন্তু নিয়ে যেতে চেয়েছিল একটা কোকিলকে। কিন্তু পাওয়া গেলে তো?
এদিকে শুরু হয়েছে ভাষার মাস। সে অবশ্য ওখানেই জেনেছে ভাষার জন্য শহীদ রফিক, শফিক, জব্বারের নাম। কিন্তু শহীদ মিনার বাস্তবে দেখা হয়নি ওর।
এবার একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাড়ির পাশের স্কুলের শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছে পাপপু। বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে সে ফুল নিয়ে যায়। কীভাবে দিতে হয় তা দেখে সেও দিয়েছে তেমন করে। শ্রদ্ধাও জানিয়েছে দাঁড়িয়ে অন্যদের দেখাদেখি। ওকে বেশ রোমাঞ্চিত মনে হয়েছে।
এর মাঝে সে অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে দাঁড়িয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা, বৌছি খেলে। না পেলেও দারুণ লেগেছে ওকে। আরো বেশি ভালো লেগেছে যেদিন মামাতো ভাইবোনেরা মিলে বনভোজন খায়। চাল আনা, ডিম আনা, বাজার থেকে তরকারি কিনে আনা, তা তৈরি করা, আবার গাছ থেকে শুকনো ডালপালা পেড়ে আনা। কাপড় দিয়ে চাঁদোয়া টাঙানো, চুলা তৈরি, কত্ত কী? অনেক রাত অবধি চলেছিল সেই আনন্দ। হাসির কা-টা ঘটেছিল তখন যখন রান্না করা ডিম চুরি হয়। তবে ওরা কিন্তু বড়দের বনভোজনে আসতেই দেয়নি।
একদিন পাশের পাড়ায় বিয়ে উপলক্ষে গীত হচ্ছিল রাতভর। পাপপুর কানে পড়লে তা দেখতে যায়। দুলিয়ে দুলিয়ে গীত গাওয়া পাপপুকে কী যে ভালো লেগেছিল! আরো দেখতে চেয়েছিল সে।
তবে চেংটা শব্দটি পাপপুকে আরও কৌতূহলী করে তুলেছিল। সে শুনে আশ্চর্যমাখা ভাব নিয়ে বলেছিলÑ চ্যাংটাÑ! আর খেয়েছিল যখন তখন মুখে দেওয়ার আগে যে কতবার দেখেছিল। তবে এই দুর্লভ বস্তুটিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর দাদু সংগ্রহ করে দিয়েছে। দেওয়ার সময় দাদু বলল, জানো দাদুভাই, আমরা যখন তোমার মতো ছিলাম তখন আমার দাদু বাজারে যেতে ধরলে আমরা চেংটা খাবার বায়না ধরতাম। যখন এনে দিত মনে হয় কী যে পেতাম! অবশ্য চেংটা খাওয়ানোর জন্য দাদু বাজারেও নিয়ে গিয়েছিল পাপপুকে। খুঁজে খুঁজে পেয়েছে একদিন। সেদিন অবশ্য সাপখেলা দেখতে পেয়েছিল ওরা। যখন সাপুড়ে সাপ ছেড়ে দিয়েছিল আর বাক্স থেকে বেরিয়ে কিলবিল করছিল, পাপপু দাদুকে জড়িয়ে ধরেছিল ভয়ে। তবে খেলা আরও কিছুক্ষণ দেখেছিল ওরা। তারপর খেলা বন্ধ করে সাপুড়েটা যখন তাবিজ বিক্রি শুরু করে পাপপু দাদুর কাছে একটা কিনে নেয়। বাড়িতে এনে কী খুশিতে সে সবাইকে দেখিয়েছিল ওটি! তবে ওটি সঙ্গে নিয়ে যাবে বলে জন্য ব্যাগে রেখে দেয় যতœ করে।
একদিন পাপপু দাদুকে বলল শুয়ে শুয়ে, দাদু, ময়ের ভাষা কত মধুর, না! আর এই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে আমাদের বীরেরা। কত গর্বের, কত অহংকারের, তাই না, দাদু? দাদু বলল, তাই দাদুভাই, তাই। অথচ আমরা কেমন যেন হেলায় দেখার চেষ্টা করি কেউ কেউ এ ভাষাকে নিয়ে। বিকৃতি ভরে উচ্চারণ করতে দ্বিধা করি না। ভাবি যে, এ ভাষায় গাঁথুনি শিখলে ওপরে উঠতে পারব না! নাতি এমন কঠিন বিষয় বুঝতে পারুক না পারুক সেও আফসোসের সাথে বলল, দাদু বইমেলা থেকে অনেকগুলো গল্পের বই, ছড়ার বই, মজার মজার বই কিনে নিয়ে যাব। দাদু বলল, শোনো দাদু ভাই, আমিও তোমাকে অনেকগুলো বই কিনে দেব। হাসিমুখে বলল, খুশি হবে না!
পাপপু দাদুর গলা চেপে ধরে বলল, হবো না মানে! বলল, দাদু সামনের গাছটাতে কী সুন্দর লাল লাল ফুল ফুটে আছে, ফাইন না!
দাদু বলল, ও ওগুলো শিমুলফুল। বসন্তকালে ফোটে। তারপর বলল, জানো দাদুভাই, আমাদের দেশে ছয়টি ঋতু। দুমাস নিয়ে একটি করে ঋতু। আর এ ঋতুগুলো তার সময়ে দারুণ দারুণ রূপ নিয়ে হাজির হয়। তেমনি এখন বসন্ত ঋতু। শুনেছ না দাদুভাই, একটা পাখি কুহু কুহ করে ডেকে চলছে!
পাপপু বলল, হ্যাঁ দাদুভাই শুনেছি। এর নাম না কী দাদু?
দাদু বলল, ঐ যে! এর নাম কোকিল। শুধু এই বসন্তকালেই এগুলো ডাকে। এদেরকে বসন্তের দূত বলা হয়।
পাপপু বলল, দাদু বেশ কিছু শব্দ শিখলাম। ঢেঁকি, ধুপি, খেজুর রস, কোকিল, বসন্ত, লাঙ্গল, হাল, বলদ, গরুর গাড়ি আর বলতে চাইলেও মনে না আসাতে থেমে গেল। তারপর বলল, কী মিষ্টি যেন শব্দগুলো!
দাদু বলল, মায়ের ভাষা না!
একদিন তাদের ফেরার সময় এসে গেল। ছলো ছলো চোখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে যাত্রা শুরু হয়।