অপু বড়ুয়া »
রিপনের মামার বাড়ি তিশরী। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই মামার বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে রিপনের। মামার বাড়ি। আহা কী মধুর মামার বাড়ি। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ক্ষেতজমি আলপথ। এদিকে ওদিকে গাছপালার সমারোহ। আর বিশাল বাগানবাড়ি পুকুরতো আছেই।
মামার বাড়ি তিশরী গিয়ে রিপনের সেই কী না হাসি-খুশির দিন কাটতো। রিপন মামার বাড়ি গিয়ে মুকুল, মানসী, বিপুল, তাপসীসহ আরও মামাতো ভাই বোনদের সাথে হৈ চৈ করে বেশ সময় কাটায়। কর্ণফুলি নদী-চানখালী নদী-শঙ্খ নদ আহা কতো চেনা। মামার বাড়ির তিশরী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা চানখালী নদীর কী ঢেউ খেলানো জল। রিপনরা সবাই মিলে তিশরী ঘাটে আসে। দেখে, যতদূর দেখা যায় নদী, নদীতে পালতোলা নৌকা; কখনো বা সেই দূরের চানপুরের লঞ্চ, অদ্ভুত বক্ বক্ শব্দ তুলে চলে যাওয়া ।
অনেক জলের ভেতর ডুবে থাকা ছুটে যাওয়া লঞ্চ দেখে কী না ভয় পেতো রিপন।
ছোট মামা বলতো, লঞ্চ অই রকম করেই ছুটে যায়, ডুবে যাওয়ার কোন ভয় নেই বুঝলি রিপন।
আদরের রিপন অবাক হয়ে ছোট মামার কথা শুনতো। সে একসময় জমজমাট মেলা বসতো ঠেঁগরপুনি। বিখ্যাত ঠেঁগরপুনি বৌদ্ধ বিহারের আশেপাশে মাঘী পূর্ণিমাতে আট দশদিন ধরে জমজমাট মেলা বসতো। মামাদের সাথে কতো আনন্দ করে সেই মেলায় ছুটে যেতো। কী যে হৈ চৈ মেলায়। কত্তো কিছুর দোকান বসতো। রিপনরা সবাই মামাদের সাথে দল বেঁধে ঘুরতো। নাগরদোলার ভোঁ ভোঁ শব্দ, মুড়ি, জিলাপির দোকানদারদের বেচাকেনার কী হাঁকডাক। সার্কাসের তাঁবুতে ঘেরা পুতুলনাচ কী যে অবাক লাগতো রিপনের। এক সময় খাজা-গজা, খেলনাপাতি, মাটির টমটম গাড়ি কিনে বেশ রাত করে ফিরতো বাড়ি। আহা আজ সব মনে পড়ে। মনে হয় যেনো এই সেদিনের কথা।
ঘাটকূলের কাছাকাছি গৌরাঙ্গ কাকার ছোট দোকান। মাটিরঘর। বাইরে বাঁশের বেঞ্চি মতোন বসার টুল করা আসন। বড়দের লুকিয়ে সেই গৌরাঙ্গ কাকার দোকান হতে বাদাম, চনাবুট, চকলেট, চিড়ার মোয়া কিনে সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে কী না আনন্দ হতো-।
গৌরাঙ্গ কাকার দোকানের পথ এগোলেই মামাদের বেনুবন বৌদ্ধ বিহার। চারপাশ ঘেরা দেওয়া বিশাল উঠোন। ওপ্রান্তে চমৎকার বিহারের হলঘর। মন্দিরের গোছনো আসনে ফুলের মাঝখানে বুদ্ধমূর্তি। কী অদ্ভুত শান্ত ভাবে চেয়ে আছে মহা-কারুণিক গৌতম বুদ্ধ। শ্বেত পাথরের ছোট বড় বুদ্ধমূর্তিগুলো গাঢ় অন্ধকারে যেনো ঝলমল করে। সবাই দলবেধে সকাল বিকাল মন্দিরের বুদ্ধকে বন্দনা করতো, ভান্তেকে বন্দনা করতো, নির্জন মন্দিরে কী যে ভালো লাগতো রিপনের। কঠিন চীবর দান-বুদ্ধপূর্ণিমায় কী না অপরুপ সাজে সাজাত বিহারকে, বিহারের চারপাশে বাতির আলোতে ঝলমল করতো। বাহ! কী আনন্দ। রিপন মুকুলদের সাথে হৈ চৈ করে ঘুরে ঘুরে প্রাণ ভরে দেখতো আনন্দ উৎসবকে। কখনো বা মুকুলদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যেতো পাশের নদী পাড়ের গ্রাম শিলালিয়ায়। সেই স্কুলের মাঠের গাছের চালতা পেড়ে আনার সেই আনন্দ এখনো খুব মনে পড়ে রিপনের।
আজ কতোদিন পরে সেই মামার বাড়ি তিশরী আসা রিপনের। রিপনের সেই চেনা অনেকের আজ দেখা হয় না। সেই আগেকার খেলার সাথীরা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। মুকুল, মানসী, তাপসী, বিপুল সবাই আজ রিপনের কাছে যেনো বেদনার অতীত। তিশরী ঘাটকূলের গৌরাঙ্গ কাকার মাটির দেওয়াল ঘরের দোকান এখন আর নেই। নদীর পাড় ভেঙ্গে পানির অতলে হারিয়ে গেছে। ছনের ছাউনিব সেই দোকানও নেই কারা কারা সেখানে পাকা দোকান ঘর দিয়েছে। ঘাটকূলে অনেক দোকানপাট। ম্যালা লোকজন।
তবে চানখালীর অবস্থা দেখে রিপনের মন ভারি খারাপ হয়ে যায়। অনেকটা শুকিয়ে গেছে চানখালী নদী, দু’পাড়ে চড় জেগেছে, আগের মতো লঞ্চ চট্টগ্রাম শহর- ফিরিঙ্গি বাজার ঘাট থেকে বাঁশখালী সরল ঘাটের লঞ্চ আর চলে না। নাই পালতোলা বাঁশখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া চট্টগ্রামের লবণের নৌকা। মামারা এখন বরকল হয়ে তিশরী-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করে। আহা! সব বদলে গেছে কালের আবর্তে।
রিপন ফেলে আসা অনেক কিছুই খোঁজে, কিছুই ফিরে পায় না। এতো বছর পর মামার বাড়ি তিশরী এসে ভীষণ মন খারাপ হয়ে বসে রিপনের। নিজের প্রয়োজনে গ্রামের বাইরে মুকুলরা। বিশালাকার মামার বাড়ির বাগানে আগের মতো গাছে গাছে ডাব-নারিকেল, পেয়ারা নেই, কাঠবিড়ালী সাবাড় করে ফেলে। পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। দাদু-দিদিমা এখন ফ্রেমে বাঁধা ছবি। রিপন তবুও মনে মনে খুঁজে ফেরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে-প্রিয় মামার বাড়ি তিশরীকে।