আরিফুল হাসান »
‘পাখিদের অভয়ারণ্যে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এই যে বটতলা, ছায়াঘেরা সবুজ বনানী, এর ভেতর আপনি কেবল পাখি হলেই ঢুকতে পারবেন।’
‘এই যে ইরির জমিন, এই যে আল, আমি এর ওপর দিয়ে হাঁটছি না। হ্যাঁ, মানছি মাঝেমাঝেই পড়ে যাচ্ছি কাদার মাঝে, কিন্তু তা বলে তো হাঁটা থামাইনি। চলছি তো। আশা করি, তোমার সাথে চলতে পারবো হাজার বছর।’
‘পারবেন না। আমি বললাম না আমি পাখি। মানুষ নই, মানবী নই। যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীর কেউ নই। একটা গাছ, একটা লতা, কিংবা একটি তৃণও ভাবতে পারেন। অথবা ভাবতে পারেন সমন্বিত প্রকৃতির আমিই কান্না। আপনি পারবেন না।’
‘দেখো পারভীন, আমিও কবিতা লিখি।’
‘হ্যাঁ, লেখেন তো। কিন্তু এ লেখায় আপনার কতটুকু কবিতা থাকে, বুঝেন তো? নাকি মেকি কাব্যময়তায় নিজেকে জাহির করতে চান প্রবলভাবেÑ সে হাহাকার থাকে। বলুন কী থাকে?’
‘তুমিই বলে দাও।’
‘থাকে অন্ধকার। একদম অন্ধকার। অন্ধের যষ্টি দেখার মতো।’
‘বুঝলাম না।’
‘আপনি কবি মানুষ, আপনাকে কি বুঝিয়ে বলা দরকার? আপনি সবই বুঝেন। কিন্তু গা ঢাকা দেন। সৌন্দর্যের কাছে, শিল্পের কাছে আপনারা বন্ধক রাখেন শ্রম ও মজুরি, তারপর তা বিলিয়ে দেন সৌন্দর্যের নামে। আসলে আপনারা ঋণগ্রস্থ, সৌন্দর্যের কাছে, কবিতার কাছে।’
‘একদম ঠিক বলেছ। আসলে আমি কবি না হয়ে তুমি কবি হলে ভালো হতো। কবিতা সম্পর্কে তোমার এত জ্ঞান দেখে অবাক লাগছে। তুমি কবিতা লেখো নাকি?’
‘হ্যাঁ, লিখতাম এক সময়! এখন আর লিখি না।’
‘তোমাদের গ্রামটাকিন্তু খুব সুন্দর! এ রকম ছায়াঘেরা সবুজ গ্রাম আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যের শেকড়। এ শেকড়কে তো অস্বীকার করা যায় না। কী, অমনভাবে তাকালে কেন? তোমার চোখ ও-আশ্চর্য সৌন্দর্যকে ঢেকে দেয়, তোমার চোখ আরও সুন্দর, প্রকৃতির চেয়ে সুন্দর।’
‘সবই মোহ, কামাল! সরি, আমি আপনাকে নাম ধরে ঢেকে ফেলেছি। শেষে না আবার ভাবেন, তিনদিন হয়নি বিয়ে হয়েছে, এখনই স্বামীকে নাম ধরে ডাকছে।’
‘আমি বরং খুশিই হবো। বরং প্রথম রাত থেকেই এটি আমার কাম্য ছিল। আরেকটি কথা, আমাকে তুমি করে বললে আনন্দ পাবো।’
‘ধন্যবাদ কামাল, আচ্ছা, আপনি তো শহরের নামকরা কবি। তো আপনার এই গ্রামের মেয়ে বিয়ে করার সখ হলো কেন?
‘মানে? কী বলতে চাও পারভীন?’
‘না, মানে, শহরে তো আপনারা অনেক আধুনিক নারীদের দেখেন, তাদের শহুরে চালচলন-পোশাক-আশাক আপনাদের ভালো লাগে। আর আপনিও তো বড় হয়েছেন শহরেই। তাহলে গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে হলো কেন?’
‘আমার মা একজন গ্রামের মেয়ে। জানো, আমার মায়ের চেয়ে ভালো নারী, সুন্দরী, সৎচরিত্রবতী এবং আধুনিকা আমি আর কোনো নারী দেখিনি।’
‘হুহ হু, হাসালেন আপনি। আপনার মাতৃভক্তি প্রবল। এটি ভালো। কিন্তু গ্রামের মেয়ের মন পেতে আপনাকে তো পাখির মতো মনের অধিকারী হতে হবে।’
‘মানে, বুঝলাম না।’
‘এই এই, পড়বেন পড়বেন, সাবধানে পা ফেলেন। মানে বলতে চাচ্ছি, আপনি যদি পাখি হন, তবেই আমাকে পাবেন।’
‘পাখি কীভাবে হবো?’
‘খুব সোজা, পাখির মতো হাত দুটি মেলে দেন, এবং ডানা ঝাপ্টাতে থাকেন। হি হি হি হি।’
‘হু হুহ হু, হাসালে গো। পাখি হওয়া কি এতই সোজা? যতই ডানা ঝাপ্টাই, যতই নিজেকে মুক্তবিহঙ্গ ভাবি, আসলে আমরা সবাই বন্দি, কেউ অন্যের, আর কেউ নিজের কারাগারে।’
‘বুঝলাম না, এবার তো আবার আপনি কঠিন করে বলতে শুরু করলেন।’
‘না, কঠিন করে বলিনি। চলো, বটের ছায়ায় বসি।’
‘না, বসবো না। তার আগে আপনি কথা দেন, আপনি পাখি হবেন।’
‘হ্যাঁ, হবো। তোমার জন্য আমি সব হতে পারি।’
‘বাব্বাহ, দুদিনেই এত ভালোবাসা। আচ্ছা, কামাল, গ্রামের মেয়েকেই যদি বিয়ে করবেন তাহলে অন্য গ্রাম কেন নয়। আমাদেরই গ্রামে এবং আমাকেই বিয়ে করতে হলো আপনার? আপনার বিয়ে অন্য কারো সাথে হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম।’
‘একি কথা বলছ পারভিন, এ বিয়েতে তোমার মত ছিল না?’
‘না, একদম না। বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আমার অন্য একটি ছেলের সাথে এফেয়ার আছে।’
‘আমি কি তোমার হাতের মুঠিটি ছেড়ে দেবো।’
‘না দরকার নেই, এতটা উদার হয়তো আপনি নন। যদি এমনই হতেন, বিয়ের আগে পারসোনালি আমার সাথে কথা তো বলতেন, নাকি? আর এখন বলছেন, হাতটা ছেড়ে দিই। শোনেন, আপনারা বিত্তশালী, অর্থ ও ধনসম্পদের অভাব নেই। বাবা ভেবেছেন, হয়তো তার মেয়েটা সুখেই থাকবে। সে আশা করেই তিনি বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার মেয়ের হৃদয় যে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, এ কথা তিনি মোটেও জানেন না।’
‘তার মানে, তুমি আসলে আমার হওনি? এই বিয়ে, বাসর রাত, সবই তোমার মিথ্যে ছিল?’
‘না, মিথ্যে ছিল না। মেনে নেয়া ছিল। মনের বিরুদ্ধে, জোর করে। কিন্তু আমি আর মেনে নিতে পারছি না কামাল। দয়া করে আপনি আমাকে মুক্তি দিন।’
‘হাতের মুঠো ছেড়ে দিলেই যদি মুক্তি হয়, তাহলে এই দিলাম। চলো, এবার হয়েছে তো, চলো বটগাছটার কাছে বসি। তারপর সব গল্প শুনবো তোমার।’
‘না, তার আগে আপনি আমাকে বলুন, আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন কিনা?’
‘মুক্তি কীভাবে চাও?’
‘সে আমাকে নিতে আসবে। এই বটগাছটার ছায়া যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, তার থেকে কয়েক শ কদম উত্তরে যে অরণ্য দেখছেন, মজনুর জঙ্গল, তারই একটি সর্পিল পথ ধরে আসবে আমার মজনু, আমি তার কাছে যেতে চাই।’
‘কী নাম সেই সৌভাগ্যবানের, মজনু?’
‘না, তার নাম বিল্লাল। আর ওই জঙ্গলটার নাম মজনুর জঙ্গল।’
‘বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো!’
‘আপনার দুটি পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে যেতে দেবেন বিল্লালের সাথে?’
‘আমার বুকের মাঝেও ব্যথা হবে। হয়তো সইতে পারবো না। কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই তোমার ভালো থাকা আমার কাম্য, যাও তুমি, যেতে চাও যতদূর, আমি তোমায় বাধা দেবো না।’
‘সত্যি দেবেন না তো?’
‘না। দেবো না। যাও, তুমি যতদূর যেতে চাও, যাও। আমি তোমাকে ভালোবেসে হৃদয়ে বসিয়েছিলাম। এই তিনদিনেই তিরিশ লক্ষ বছরের প্রেম তোমার জন্য জাগ্রত হয়েছে প্রাণে। এখন আমি এসব ভুলে যাবো। ভুলে যাবো, বড় সখ ছিল গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করার। গ্রামের সহজ-সরল মেয়েকে প্রাণভরে প্রকৃতির মতো প্রেম দেবার। কিন্তু, তুমি যেতে চাও, আমি ধরে রাখতে চেষ্টা করবো না। হাসি মুখে মেনে নেবো সব। হয়তো আমার নিয়তিই এমন ছিল। নইলে বিয়ের তৃতীয় দিনের মাথায়, শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে পৃথিবীর কোনো স্বামীকে এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে কিনা আমি জানি না। আমি জানি না, সত্যিই আমি মানতে পারবো কিনা। তোমাকে হয়তো চলে যেতে দেবো, কিন্তু তোমাকে হারিয়ে বাঁচবো কিনা সে নিয়ে সন্দেহ আছে। আড়চোখে চেও না, এটিই সত্যি।’
‘চলুন, বটগাছটির গোড়ায় চলুন। কই, আমার হাতটি ধরুন। কী, ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছেন কেন? আরে, আমি এতক্ষণ আপনার সাথে দুষ্টুমি করছিলাম। একদম। রিয়েল ছিলনা সেটা। হা হা হা।’
‘সত্যি!’