রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। শিক্ষার্থীদের কেউ ক্লাস করছিল, কেউ ছুটি শেষে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন অভিভাবকেরা। রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে অন্য দিনের মতো সোমবার দুপুরেও ছিল এমন চেনা ব্যস্ততা। বেলা একটার পর হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ। মুহূর্তেই আগুন, ধোঁয়া আর চিৎকারে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আগুন ধরে যায় স্কুল ভবনে। তখন দগ্ধ শিশুদের আর্তনাদ, সন্তানের খোঁজে পাগলপ্রায় মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ।
পরে জানা যায়, বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান স্কুলটির চত্বরের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উত্তরার ওই স্কুল ভবনে আছড়ে পড়েছিল। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বেলা ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটি স্কুল ভবনের ওপর এসে বিধ্বস্ত হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আইএসপিআরের বরাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩১ বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার সকালে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় আহত ১৭১ জন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৭৮ জন।
দেশে গত এক দশকে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এর কোনোটিতে পাইলট আহত বা নিহত হয়েছেন। কোনোটি বিধ্বস্ত হয়েছে জনবসতি থেকে দূরে। তবে এবারের মতো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক দশকে একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পরও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি বিমান বাহিনীর বহরে কিংবা নীতিনির্ধারণে। যুক্ত হয়নি আধুনিক যুদ্ধবিমান। পুরনো প্রযুক্তির এয়ারক্রাফট দিয়েই চলছে বাহিনীর কার্যক্রম।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে আছে মোট ৪৪টি যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে ৩৬টিই চীনের তৈরি এফ-৭ সিরিজের। যেগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে ২০১৩ সালে। বাকিগুলো সোভিয়েত আমলের মিগ-২৯। আধুনিক যুদ্ধে বা প্রশিক্ষণে এসব বিমান কতটা কার্যকর—সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের এ জেটগুলো নতুন প্রজন্মের স্টিলথ ও আধুনিক রাডার প্রযুক্তির সামনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
এ ধরনের অনেক আলোচনা-সমালোচনা উঠে আসবে এখন। কিন্তু ফুলের মতো নিষ্পাপ যে শিশুরা প্রাণ হারালো কিংবা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে তাদের জন্য আমাদের সান্ত্বনার বাণী কী হতে পারে। কোন শব্দাবলী দিয়ে আমরা দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য একটি শোকগাথা রচনা করতে পারি। এ দুর্ঘটনার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, রাজধানীতে প্রশিক্ষণ বিমান চালানোর অনুমতি দেওয়া কতটা যৌক্তিক।
দুর্ঘটনার পরে অনেকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। অনেকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন। এটি যেমন স্বস্তির খবর তার পাশাপাশি আছে অস্বস্তির সংবাদও। অনেকে অহেতুক ভিড় করে উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছেন। অনেকে হাসপাতালে অযথা ভিড় করছেন। দগ্ধ রোগীদের জন্য যে ধরনের সুরক্ষার দরকার তা তারা করতে দিচ্ছেন না। এটা যে অনুচিত তা তারা স্বীকারই করছেন না।
আমরা প্রত্যাশা করব সবাই যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। বিপদ ও দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার জন্য ধৈর্য ও সহনশীলতার হাত প্রসারিত করবেন।