আজ ১ মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সংহতি চেতনা, জীবনÑজীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করার দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোর হে মার্কেটে কয়েক লক্ষ শ্রমিকÑজনতা কাজের শ্রমঘণ্টা কমানো, ন্যায্য মজুরি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের মাধ্যমে যে গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন তার মহিমা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের চিরকাল অনুপ্রাণিত করে চলেছে তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়। মানুষের সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ, ভোগের সামগ্রী, বিপুল নির্মাণযজ্ঞÑএসব শ্রমজীবী আর সাধারণ মানুষের মেধা, শ্রম থেকে উৎসারিতÑএক কথায় বলা চলে মানব জাতির অগ্রগমনের সচল রথের সারথি তারা।
আজ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির চরম বিপর্যয় ও দুর্দিনের সময় মে দিবস এসেছে, করোনা ভাইরাস মহামারির রূপ নিয়ে বিশ্বসভ্যতা ও মানবজাতিতে এক ভয়ানক দুর্যোগে নিক্ষেপ করেছে। এই মরণঘাতি ব্যাধি ইতিমধ্যে বিশ্বের ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সংক্রমিত হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনÑজীবিকাÑঅর্থনীতি, উন্নয়ন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ চলেছে। করোনার টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ এই হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে আলোর সংকেত দিচ্ছে যদিও মহামারি কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারছেনা, বরং রোগটির নতুন ধরণও সংক্রমণের তীব্রতা মানুষকে অসহায় করে তুলেছে।
আমাদের দেশে এই মানবিক ট্রাজেডির মধ্যে এসেছে মে দিবস। করোনায় ইতিমধ্যে আমাদের দেশে এগার হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারী যারা করোনাকালে সম্মুখ সারিতে থেকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তাদের বেশ কিছু মানবহিতৈষী প্রাণÑঅকালে ঝরে গিয়েছে করোনার ছোবলে। এই সময় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংগীত, চিত্র ও চলচ্চিত্র শিল্পীসহ সৃজনশীল ও মননশীল অনেক ব্যক্তিত্ব করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন যা আমাদের জাতীয় জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি।
জীবনÑজীবিকার স্বার্থে উৎপাদন ও নির্মাণকাজ সীমিতভাবে চলছে। দেশের অর্থনীতির মূল যে ৩টি উপাদান যথাÑকৃষি, শিল্প উৎপাদন, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স এই বিপদের সময় ও অব্যাহত রয়েছে। তবে এই করোনা সময়ে অনেক শ্রমজীবী মানুষ তাদের পেশা ও চাকুরি হারিয়েছেন, গ্রামের কৃষক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র, কুটির শিল্পের কারিগর এবং শহরের শ্রমজীবী, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ খুবই কষ্টে পড়েছেন। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে অভাব প্রকট হয়েছে, অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেনÑ অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস আজ বড়ই করুণ। প্রবাসী শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের কাহিনী প্রতিদিন সংবাদপত্রে আসছে। দেশের গরিব ও নি¤œআয়ের মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত, তাদের মৌলিক অধিকারগুলি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সম্প্রসারণ, নিয়মিত সাহায্য প্রদান, কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, শ্রমজীবী মানুষের বেতনÑভাতা নিয়মিত প্রদান, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকÑকর্মচারীদের সহায়তাÑএসব কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, শ্রমিকদের ছাঁটাই না করা, নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য হ্রাস, তাদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, গৃহস্থালী ও কৃষিকাজে তাদের শ্রমের মূল্যায়ন উৎপাদনশীলতার স্বার্থেই প্রয়োজন।
কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, মর্যাদা রক্ষাও তাদের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সমাজ ও রাষ্ট্রকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। মে দিবসের এই মর্মবাণী আমাদের সংগ্রামকে উজ্জীবিত করুক। করোনার এই সময়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ভেদাভেদ ভুলে এই প্রাণঘাতি রোগের মোকাবেলা করি। স্বাস্থ্যবিধি পালন করে জীবন ও জীবিকার সংগ্রামকে এগিয়ে নিই।
মতামত সম্পাদকীয়