আখতারুল ইসলাম :
হিরাডোটাসের লেখা ইতিহাসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৭ম শতকেই ইজিয়ান সাগরের পূর্বতীরে বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিলো। বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম তীরে প্রাচীন মাইলেটাস নগরীতে সেই সময় যে মহান এক ব্যক্তির জন্ম হয়েছিলো তিনিই হলেন বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রের আদিজনক বলে খ্যাত মহাজ্ঞানী থ্যালিস।
বিজ্ঞানী থ্যালিসের জন্ম হয়েছিলো ৬২৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। তাঁর জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে আজ আর বিশেষ কিছু জানার উপায় নেই। শুধু এতটুকু জানা যায় যে, থ্যালিস প্রথম জীবনে শিক্ষালাভের জন্য এসেছিলেন তৎকালীন মিশরে। সে সময় মিশর ছিল শিক্ষাদীক্ষায় খুব উন্নত। তিনি পড়াশোনার জন্য ব্যাবিলন পর্যন্ত এসেছিলেন বলে জানা যায়।
মিশরে এসেই থ্যালিস গণিত শাস্ত্র, বিশেষ করে জ্যামিতিক রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত ইত্যাদি আঁকেন। জ্যামিতির এই মূলসূত্রগুলো কিন্তু তিনিই দিয়ে গেছেন। যদিও তাঁর সূত্র অনুসরণ করে পরবর্তীকালে পিথাগোরাস এবং অন্যান্য দার্শনিকরা একে আরো উন্নত করেছেন, কিন্তু আদিসূত্র থ্যালিসই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। একটি সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি সংলগ্ন কোণ দুটি পরস্পর সমান। দুটি সরল রেখা যদি পরস্পরকে ছেদ করে তাহলে যে কোণ উৎপন্ন হয়, তার বিপরীত কোণগুলো পরস্পর সমান। কোনো বৃত্তের ব্যাসের ওপর যদি লম্ব আঁকা হয় তাহলে তার বিপরীত কোণগুলো হবে সমান কোণ। একটি ত্রিভুজের একটি তিনটি কোণ হল দুই সমকোণের সমান।
তিনি শুধু একটি ত্রিভুজের সাহায্যে অংক কষে, কোনো গজফিতে ছাড়াই, কোনো বস্তুর দূরত্ব মাপার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। কৌশলটি এরকম : ক খ একটি বস্তু। এই বস্তু থেকে দূরে গ স্থানে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। খ থেকে গ কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাই বের করতে হবে। তখন খ ক স্তম্ভের মাথায় একটি লোক উঠে গিয়ে দাঁড়ালো যার চোখ ছ বিন্দু পর্যন্ত উঁচু। তিনি ছ বিন্দু থেকে গ বিন্দু পর্যন্ত সরল একটি দৃষ্টিপাতের রেখা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। এখন ¯তম্ভের ক বিন্দুতে একটু বাড়িয়ে দিলে তা ছ গ দৃষ্টিরেখার প বিন্দুতে ছেদ করে। তাহলে এখন ছ প ক একটি ত্রিভুজ হল। এখন এই ছ প ক ত্রিভুজের ছ ক একটি বাহুর চেয়ে ক ক স্তম্ভের উচ্চতা যে তুলনায় বড় প ক বাহুর চেয়েও খ গ বাহু সেই তুলনায় বড়। অর্থাৎ যদি খ ক স্তম্ভটি ৩৩ মিটার লম্বা হয় এবং ছ ক বাহুটি ৩ মিটার লম্বা হয় তাহলে অনুপাতা হয় ৩৩:৩। তার মানে ছ ক বাহুটির তুলনায় স্তম্ভটি ১১ গুণ লম্বা। এখন একই পদ্ধতিতে যদি প ক বাহুটি ৫ মিটার লম্বা হয় তাহলে গ খ বাহুর দৈর্ঘ্য হবে ৫ঢ১১=৫৫ মিটার। অর্থাৎ লোকটি ৫৫ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে অংকটির সূত্র দাঁড়ালো।
গ খ = খ ক
প ক = ক ছ
তিনি শুধু অংকশাস্ত্রবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহু গুণের আধারও। একাধারে প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। মহাজ্ঞানী থ্যালিসের দার্শনিক মতবাদ ছিল বিস্ময়কর। তিনি মনে করতেন, বিশ্বের পদার্থগুলোর মূল উপাদান একটি। তিনি বলেন, বস্তু জগতের আদি উপাদান হল পানি। পানি থেকেই বিশ্বের যাবতীয় বস্তুর জন্ম। পানিই রূপান্তরিত হয়ে নানা বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কোন যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
তবে এ সম্পর্কে পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল বলেছেন, উদ্ভিদ এবং যাবতীয় প্রাণ সংরক্ষণে পানির অপরিহার্যতার কথা চিন্তা করেই হয়তো থ্যালিস সমস্ত বস্তুর মূল উপাদান পানি বলে মনে করেছিলেন।
থ্যালিস মনে করতেন পানিই ঘনীভূত হয়ে বায়ুতে রূপান্তরিত হয়। অবশ্য থ্যালিসের এ ধরণের চিন্তার পেছনে কিছুটা পটভূমিও আছে। হোমারের সময় গ্রিকরা ওশেনিয়া বলে এক দেবতার পূজা করতো। তখন ওশেনিয়া বলে এক দেবতার পুজা করতো। তখন ওশেনিয়া বলতে বোঝাতো নদী। পরে এর অর্থ দাঁড়ায় মহাসমুদ্র। মহাসমুদ্রের বিশালতায় তারা মুগ্ধ হয়ে যেত।
সেকালে গ্রীসের মাটি খুব উর্বর ছিল না, তারা ব্যবসা বাণিজ্যের বেলাতেও সমুদ্রের ওপর নির্ভর করতো, তাদের জীবন ছিল সমুদ্রনির্ভর। সমুদ্র মানেইতো পানি আর পানি। থ্যালিসের চিন্তা ধারার মূল ভিত্তিও ছিল এটি। অবশ্য দার্শনিক থ্যালিসের মতবাদ এখন অপরিণত এবং ভ্রান্ত বলে মনে হতে পারে। তবু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে সভ্যতার প্রায় আদিযুগে বস্তুজগৎ সম্পর্কে এই ধরণের চিন্তা কম কথা নয়। মূলত বস্তুজগতের বহুত্বের মধ্যে একত্বের সন্ধানের ওটিই ছিল প্রথম প্রচেষ্টা।
এই বিশ্বজগৎ, ঈশ্বর এবং দৈব শক্তি সম্পর্কেও তিনি তাঁর মত ব্যক্ত করেছিলেন। সেকালে সবাই ভাবতো পৃথিবীর মানুষের কার্যকলাপের সাথে দেবতারাও জড়িত, মানুষের ভাগ্য দেবতার হাতে।
যেমন- হোমারের ইলিয়ডে, ওডেসিতে, ট্রয়ের যুদ্ধে দেবতারা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।
[থ্যালিস বলতেন, পৃথিবীর মানুষের সাথে স্বর্গের দেবতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি তিনি স্বর্গের তথাকথিত দেবতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলতেন, বিশ্বসৃষ্টি এবং এর যাবতীয় কার্যক্রম সব প্রাকৃতিকভাবেই হচ্ছে। এর মধ্যে দেবতাদের কোনো হাত নেই। সেই আদি যুগে এ ধরণের চিন্তা কতখানি বিস্ময়কর, তা আজ ভাবাও যায় না।
তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রেও ছিলেন আশ্চর্য রকমের পারদর্শী। তিনি চন্দ্র সূর্যের গণনা করতে পারতেন প্রায় নিখুঁতভাবে। তার একটি জ্যোতিষ গণনা হুবহু ফলেছিলো খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দে। এর বহু আগেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন-শীঘ্রই সূর্য রাত্রির মধ্যে ডুবে যাবে এবং চন্দ্র এসে সম্মুখে দাঁড়াবো।
তাঁর এই গণনা মতোই ৫৮৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পূর্ব ইউরোপে একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিলো এবং দ্বিপ্রহরের সময় সূর্য ঢেকে গিয়েছিলো। সেই অন্ধকারের চাঁদের আলো দেখা গিয়েছিলো। এই বছর যে সূর্যগ্রহণ হবে তা তিনি বহু পূর্বেই গণনা করে বলেছিলেন।
এদিকে দার্শনিক থ্যালিসের এই ভবিষ্যৎ বাণী সত্যে পরিণত হওযায় সারা দেশ জুড়ে হই চই পড়ে গেল। তিনি রাতারাতি হয়ে উঠলেন বিখ্যাত।
এই সূর্যগ্রহণে ঘটেছিলো আরো মজার কা-। এই সময় লিডিয়ানস এবং মেডেসদের মধ্যে চলছিলো যুদ্ধ। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে চলছিলো এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সূর্যগ্রহণ হওয়ার পর দুটি বিবদমান রাজশক্তিই গেল ঘাবড়ে। তারা মনে করলো এই রাতের অন্ধকারে সূর্য হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা হয়তো পৃথিবীর মানুষের অসৎকর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তার হুঁশিয়ারি। তাদের বিবাদ আর পাপের জন্যই এমন অলৌকিক ঘটনা হচ্ছে। এই ভয়ে দুপক্ষই ঘাবড়ে গেল। তারপর শত্রুতা ভুলে গিয়ে তারা পরষ্পরের সঙ্গে করলো সন্ধি। শত্রুতা পরিণত হল মিত্রতায়।
দুষ্টলোকেরা সেকালে প্রচার করতো-দর্শন চর্চা করে পেটের ভাত হয় না। থ্যালিস এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য সেবার মাইলেটাস শহরের সমস্ত জলপাই কিনে গুদামজাত করেন। পরে জলপাই এর অভাবে তার দাম খুব চড়ে যা। তখন তিনি চড়া দামে মাল বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। এটি ছিল তাঁর জেদ।
ঘর সংসার সম্পর্কে চিরকুমার থ্যালিস ছিলেন একেবারেই উদাসীন। অল্পবয়সে যখন তাঁর মা তাঁকে বিয়ের কথা বলেছিলেন, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-এখন বিয়ে করার সময় হয়নি। আবার যখন শেষ বয়সে মা তাঁকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করলেন, তখন তিনি উত্তর দিলেন, এখন আর বিয়ে করার সময় নেই।
এই মহাজ্ঞানী থ্যালিসের আরো বহু অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার আছে। বস্তু ঘর্ষণের দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়-এটি থ্যালিসই প্রথম আবিষ্কার করেন। তাঁর এই আবিষ্কারকে এতদিন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেজন্যই থ্যালিসের মৃত্যুর ২০০০ বছর পরে মানুষ প্রথম তড়িৎ শক্তির সন্ধান পায়। তিনি চুম্বক শক্তির ওপরেও গবেষণা করেছিলেন।
এই মহান দার্শনিকের মৃত্যু হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে। কিন্তু আজো বিজ্ঞান আর দর্শনের জনক বলে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।