শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজের সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এশার নামাজ আদায় করতে যেসব মুসল্লি মসজিদে এসেছিলেন, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে দগ্ধ অবস্থায় টেনেহিঁচড়ে বের করে আনতে হয়েছিল তাঁদের। যন্ত্রণায় কাতর মুসল্লিদের অনেকেই কষ্ট লাঘবের জন্য গড়াগড়ি খেয়েছিলেন মসজিদের সামনের রাস্তায় জমে থাকা সুয়ারেজের পানিতে। তাঁদের কারও কারও গায়ের চামড়াও খসে পড়ছিল। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত ৩৭ জনকে রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এ পর্যন্ত এক শিশুসহ তাঁদের ২০ জনই প্রাণ হারিয়েছেন। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
ঘটনা খতিয়ে দেখতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা, ফরেনসিক ইউনিট, ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ দল, মন্ত্রী, সাংসদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থলে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের সংযোগ থেকে ছিদ্র পথে গ্যাস বেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। তারপর কোনো একপর্যায়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে বিস্ফোরণ হয়। মসজিদ কমিটিসহ এলাকার লোকজন বিস্ফোরণের জন্য তিতাস গ্যাসকে দায়ী করেছেন। তাঁদের দাবি, গ্যাসের পাইপ ফুটো হওয়ার খবর জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, আগুনের স্থায়িত্ব ছিল কম। সে কারণে পোড়া দাগও কম। ধোঁয়ারও কোনো চিহ্ন নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে গ্যাসের সংযোগ থেকেই বিস্ফোরণ হয়েছে।
তবে মসজিদে বিস্ফোরণের জন্য মসজিদ কমিটি ও তিতাস গ্যাসের অবহেলাকে দায়ী করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, মসজিদে গ্যাসের গন্ধ তাঁরা অনেক দিন ধরেই পাচ্ছিলেন। মসজিদ কমিটির সদস্যরাও এখানে নামাজ পড়েন। তাঁরাও বিষয়টি জানেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুর গণমাধ্যমকে বলেন, ৮-৯ দিন ধরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। বিষয়টি কমিটির সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাউদ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। তখন সংযোগ ঠিক করে দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তাঁরা টাকা জোগাড় করতে না পারায় গ্যাসের ছিদ্র মেরামত হয়নি।
মসজিদ কমিটির অভিযোগের ব্যাপারে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মফিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, গ্যাস ছিদ্রের বিষয়ে তাঁদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। টাকা দাবির অভিযোগও সত্য নয়। ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রী বলেন, এই মসজিদে যেভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র লাগানো হয়েছে, সেটা আদৌ ঠিক হয়েছে কি না, বা সেখানে বিদ্যুতের অনুমোদিত চাপ আছে কি না, তা দেখা উচিত। এ ধরনের মসজিদে এত এসির ব্যবহার খুবই বিপজ্জনক। এসময় তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরে যত ভবন হয়েছে, প্রায় সবই অবৈধ। এগুলোর একটাও রাজউকের অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার কারণ বের করা হবে বলে সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন। ওই ঘটনা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটছে, সে ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি বের হবে।’
এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। কার বা কাদের অবহেলায় এত লোকের প্রাণ গেল তা খুঁজে বের করার সঙ্গে সঙ্গে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একঠি ভবন তা মসজিদ হোক আর আবাসিক বা বাণিজ্যিক যাই হোক তা অনুমোদনহীনভাবে গড়ে উঠতে পারে না। রাজউক, তিতাস গ্যাস কোম্পানি ও মসজিদ কমিটি কেউই দায় এড়াতে পারে না।
মতামত সম্পাদকীয়