মনে হয় যেন নতুন বই নিয়ে শাটলে ঝুলছি

প্রথম বই

শাহীন মাহমুদ »

 

‘গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘসংঘর্ষের

জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের

অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন

এক দিনে-

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের মেঘদূত কবিতায় এই ৪টি লাইনে অনেকগুলো শব্দ আছে এই অনেকগুলো শব্দের মধ্যে একটা হলো ‘অন্তর্গূঢ়’। এই শব্দটি আমার ভীষণ মনে ধরেছিলো সে সময়।

কলেজ পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ আমি। টুকটাক ছোট গল্প, কবিতা এসব লিখে ডায়েরির পাতা সব শেষ করে ফেলা আর তপন চৌধুরীর গান ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া এটাই ছিলো আমার রুটিন ওয়ার্ক। যাক সে সব কথা নাইবা বলি  মুল আলোচনায় আসি, এই  ‘অন্তর্গূঢ়’ শব্দটি সেদিন মনে হয় মগজে সেভ হয়ে গিয়েছিল।

আজকের আলোচনায় এই শব্দটি প্রাসঙ্গিক। আশাকরি একটু আগালে আপনারা বুঝতে পারবেন। স্কুলে পড়াকালীন দেয়ালিকায় কবিতা লিখতে গিয়ে আমার লেখালেখির হাতে খড়ি হয়েছিলো। তারপর আরও একটু যখন বড় হলাম-একদিন  মহসিন কলেজে ম্যাগাজিনে একটি গল্প লিখে বন্ধুদের প্রশংসা পেয়ে  নিজেকে লেখক ভাবা শুরু করলাম। অনেক কবিতা গল্প লিখে বন্ধুবান্ধব কিংবা বড় ভাইদের শোনাতাম। শুরুতে বলে রাখতে চাই আমার একাডেমিক নাম ছিলো মো, আবদুল মতিন শাহীন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই (মিলাদ ভাই) একদিন বলে বসলো,  ‘কি খবর কবি শাহীন মাহমুদ’ ? অবশ্যই কবি বলে  ডাকার ক্ষুদ্র  কারণও আছে, তিনি নিজে তখন দৈনিক পত্রিকাগুলোতে কবিতা লিখতেন । তাই আমাকেও কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। সে দিন তিনি ঘোষণা দিলেন আজকে থেকে তুমি শাহীন মাহমুদ নামে লিখবে। ওই কবি ভাইয়ের সম্মোধনটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। ব্যাস সে থেকে লেখক শাহীন মাহমুদের পথচলা।

সালটা ছিলো ১৯৯৪। ছয় ফর্মার একটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি রেডি। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজের মুলধনে ছাপাখানায় উঠে পড়লো আমার জীবনের প্রথম উপন্যাস  ‘অন্তর্গূঢ় দিশা’। শুরুতে যে অন্তর্গূঢ় শব্দটি রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় লিখেছিলেন বলেছিলাম সে শব্দটি ফিরে এলো আমার তারুণ্যে, আমার জীবনে আমার প্রথম উপন্যাসের শিরোনামের সাথে যুক্ত হয়ে। মেঘদূত কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ‘গম্ভীর নির্ঘোষ’ বলতে মেঘের গর্জন এবং ‘সহস্র বর্ষের অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন’- মানে  দীর্ঘদিনের লুকানো দুঃখ ও কান্নার কথা বোঝাতে চেয়েছেন। ‘অন্তর্গূঢ় দিশা’ উপন্যাসের নায়িকা দিশার লুকানো বিষাদ নিয়ে আমার কাহিনী এক অনিশ্চিত গন্তবের দিকে এগিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের পাঠানটুলিতে ছিলো ইউনিক প্রিন্টিং প্রেস। মালিক ছিলেন জামসেদ  নামের আমার এক বন্ধু ইব্রাহিমের বড় ভাই। ওনার পরামর্শে এক হাজার কপি গ্রন্থ ছাপানো হয়েছিলো ওনার স্বরলিপি প্রকাশনী থেকে। ভাবতে অবাক লাগে মাত্র চার মাসে আমার উপন্যাসের সমস্ত কপি সাবার করে দিয়েছিলো আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা, শাটল ট্রেনের বন্ধুরা। এমন কি আমার দুবোনও তাদের বন্ধু বান্ধবীদেরকে দশ কপি দশ কপি ধরিয়ে দিয়েছে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে শাটল ট্রেনের বগি থেকে বগি ঝুপড়ি থেকে ঝুপড়ি শাহজালাল, এফ   রহমান হলের দেয়ালগুলো ভরে গিয়েছিলো আমার ছবি সম্বলিত রঙিন পোস্টারে। ‘বের হয়েছে বের হয়েছে তরুণ লেখক শাহীন মাহমুদের লেখা রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস  ‘অন্তর্গূঢ় দিশা’। আহা সে কি আনন্দ! বান্ধবীরা এক একজন ২০/৩০ কপি করে সেল করেছে।

আহা সে-ই সোনালতা মোড়ানো দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও পুলকিত হই, দিশেহারা হয়ে সে সব বন্ধুদের খুঁজি। তারণ্যের সেই দিনগুলোতে আমার এই প্রথম গ্রন্থ পুশ সেল করে যে পরিমাণ লাভ করেছি তা আর এই জীবনে আর কোনো উপন্যাস কিংবা কাব্য লিখে পাইনি, পাবোও না।। তবে আমার দ্বিতীয়  উপন্যাস ‘ছুঁয়ে দাও একবার’ ও তৃতীয় উপন্যাস ‘হৃদয়ে তুলির আঁচড়’  লিখে রয়্যালটি পেয়েছিলাম। ‘ছুঁয়ে  দাও একবার’ উপন্যাসটি  আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে হোয়াইট প্রিন্ট নিউজ প্রিন্ট মিলে অষ্টম সংস্করণ পর্যন্ত বের করেছেন আমার প্রকাশক ঢাকার সাহিত্যমালা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী অরুণ বাবু। আসলে ৯৬, ৯৭ সালে ছিলো হুমায়ুন, মিলন, নিশাত চৌধুরী ও কাসেম বিন আবু বকরের কব্জায়। সে যুগে ঢাকার প্রকাশকদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেও কেন জানি হাল ছেড়ে দিলাম। আমার প্রথম উপন্যাসের কথা মনে পড়লে হঠাৎ মনে হয় বই ভর্তি কালো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ষোলশহর রেল স্টেশনে ৭.২০-এর ট্রেনটি ধরবো বলে। পুরানো স্মৃতিগুলো রকেট গতিতে মনে করিয়ে দেয় এইতো আমি ব্যাগভর্তি  ‘অন্তর্গূঢ় দিশা’ নিয়ে প্রিয় শাটলে ঝুলছি।

 

অন্তর্গূঢ় দিশা

প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর -১৯৯৪

প্রকাশক – স্বরলিপি প্রকাশনী

প্রচ্ছদ – মিলন দাশ

মূল্য – ৫০ টাকা।