ড. আনোয়ারা আলম »
মহান ভাষার মাস এলেই আমরা মাতৃভাষা নিয়ে কথা বলি। ভাষা দূষণ নিয়ে সোচ্চার হই। সারা বছরের অবহেলিত শহীদ মিনারে ঘষামাজা চলে। বিভিন্ন সভায় সেমিনারে ভাষা নিয়ে কথার কতো ফুলঝুরি। এর পরে আবারও সেই যেমন সেই তেমন। আহা! আমার বাংলা ভাষা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। এই ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই ধাপে ধাপে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যামে আমরা এনেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর এই স্বাধীন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা কতো অবহেলিত। বিশেষত ইংরেজি ভাষার প্রতি এতো আকর্ষণ, এতো প্রীতি! হায়! মাতৃভাষা! হায় বাংলা ভাষা। আমরা এখনো এটিকে শিক্ষার একমাত্র বাহন করতে পারিনি। এখনো ভাষার দূষণ বন্ধ করতে পারি নি। এখনো এর প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দিতে পারিনি, এখনো মাতৃভাষাকে বুকে লালন ও ধারন করতে পারি নি। এর দায়ভার আামাদের, এ ব্যর্থতা আমাদের।
মাতৃভাষার জন্য মানুষের মমতা সহজাত। এর বিকাশ ঘটুক, মাতৃভাষা জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত হোক এটা সবার কাম্য।
এমন একদিন ছিল যখন মাতৃভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার কোন পদ্ধতিগত অধিকার মানুষের হাতে ছিল না। তখন রাজবংশের ভাষাই হত সরকারি ভাষা এবং সে ভাষাই ধীরে ধীরে শিক্ষার বাহন হয়ে জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত হত। ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বরং ভাষার অধিকার স্বীকৃত না হলে কি অনর্থ সৃষ্টি হতে পারে তার প্রমাণ বাংলাদেশ,যার ইতিহাস এখন পুরো বিশ্বের কাছে এক অনুকরণীয় আদর্শ। বাংলাভাষা এখন আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এ গানটি কি অপার ভালবাসাময় গাওয়া হয়! অথচ এই ভাষার প্রতি কি অবহেলা আমরাই করছি, নানাভাবে।
ভাষাকে নিয়ে কি গর্বের শেষ আছে! অসির চেয়ে মসী বড় – এ প্রবাদ কেবল প্রবাদেই সত্য নয়,বরং ভাষার মূল্য এখন সে প্রবাদের সত্যিকেও ছাড়িয়ে গেছে। কারণ ভাষা কেবল আত্মরক্ষাই সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার নয়, আত্মবিকাশেরও সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এ পরম সত্যিকে কেন আমরা উপলব্ধি করতে পারছিনা,এ ব্যর্থতা কার! পৃথিবীর সব ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করি কিন্তু সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া দরকার মাতৃভাষাকে। কিন্তু সর্বত্র ইংরেজি প্রীতি। চারপাশে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের ছড়াছড়ি। এছাড়া ন্যাশন্যাল কারিকুলাম, মিশনারি স্কুল, ব্রিটিশ কারিকুলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই বলছেন দেশের উন্নয়নের জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কথাটার মাঝে এক গোপন সত্যি নিহিত। জাপান বা চীন বা জার্মানির মতো বাংলা ভাষা চর্চা বা উন্নয়নে আমরা এতো বছর পরেও এগুতে পারিনি। আর স্বাধীনতার এতো বছর পরেও শিক্ষানীতি বা শিক্ষা ব্যবস্থায় এতো কাটাকাটি এতো পরীক্ষা নিরীক্ষা! অভিভাবকেরা দিকভ্রান্ত। যার অল্প সামর্থ্য আছে , সেই ছুটছে ইংরেজি মাধ্যমে বা সন্তানকে পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের বাইরে। এটি এক অশনিসংকেত।
এছাড়াও ভাষা দূষণ হচ্ছে নানাভাবে। বিকৃত উচ্চারণ, ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষার শব্দ মিশ্রণ, বানান বিকৃতিসহ পত্রপত্রিকায়, ইন্টারনেট ব্লগে নানাভাবে বাংলা ভাষা দূষিত হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন পোষাকে তেমনি উপস্থাপনায় বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার মিশেল নাটকে আঞ্চলিক ভাষার অপপ্রয়োগ, এফ এম রেডিওতে যে ভাষার প্রয়োগ তা সত্য গভীর বেদনার। একই সাথে কিছু অভিভাবকেরাও একধরনের আভিজাত্যবোধে বলেন যখন- আমার সন্তানেরা ইংরেজি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তখন মনে হয় – হা মরি বাংলা ভাষা। তবে কারণও আছে আমরা কি ভাষাকে তেমন জায়গায় নিতে পেরেছি! এখনো কি সত্যিকার অর্থে সঠিক মর্যাদায় ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। নিত্যনতুনভাবে কেবলি বাংলাভাষার পরিবর্তনই হচ্ছে, কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে বা অনুবাদে কতোটা কাজ হয়েছে!
এখনো সাইনবোর্ড বা বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর নামে যখন এতোটাই ইংরেজ প্রীতি আর এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা ও নেই। তখন মনে হয়- হায়! এই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের প্রতি কতোটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে? ভাষা মানুষের মানস প্রসারের প্রধান হাতিয়ার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানুষ তার কল্যাণের জন্যই গড়ে তুলেছে। সুতরাং রাষ্ট্রব্যবস্থা তো এমন হতে পারেনা যা ভাষার বিকাশকে ব্যাহত করতে পারবে।
মহান ভাষার মাসে আমাদের এ কথাগুলো ভেতরে আসে, আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু এর পরে ভুলে যাই বা ভুলে থাকি।
এবারেও তাই হবে। আমরা কথা বলবো, আকুতি জানাবো, দাবি জানাবো। একই সাথে পুরো বছরের অবহেলিত শহীদ মিনারে ফুল দেবো। গান গাইবো। আবারও ফিরে যাবো পুরনো অবস্থানে।
পরিশেষে ভাষা-শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রত্যাশা করি বাংলা ভাষার চর্চায়, মর্যাদা রক্ষায় আসুন ভাষা দূষণ থেকে বাংলা ভাষার বিকাশে নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে পরিবার সমাজ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যথাযথ পদক্ষেপে আমরা সবাই আন্তরিক হই।