আবদুল মান্নান »
বাংলাদেশ ভারত হতে যে’কটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করে তার মধ্যে পেঁয়াজ একটি । বাংলাদেশের বাঙলিরা পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হতে পারে তা আবার বিশ্বাস করতে চায় না। সতের কোটি মানুষের প্রতি বছর ত্রিশ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ প্রয়োজন । দেশে উৎপাদিত হয় তেইশ লাখ টন । কৃষক তার ঘরে তোলার সময় পাঁচ হতে ছয় লাখ টন নষ্ট হয়। অর্থাৎ ১৮ হতে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ গ্রাহকের কাছে যায় । ঘাটতি পূরণে বিদেশ হতে আমদানি হয় এগার/বার লাখ টন যার প্রায় সবটাই আসে ভারত থেকে। অর্থাৎ বাঙালির এই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পণ্যটির একমাত্র আমদানি উৎস ভারত যা যে কোন মাপকাঠিতেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পেঁয়াজ একটি কৃষিপণ্য যার উৎপাদন অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে, এর একটি হচ্ছে প্রকৃতি যার ওপর মানুষের কোন প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারতে এই বছর বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ কম উৎপাদন হয়েছে এই অজুৃহাতে কোন আগাম বার্তা না দিয়ে গত সোমবার ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি যে গুলো আমদানি করার জন্য বাংলাদেশের আমদানিকারকরা এলসি খুলেছিল তার চালানও বন্ধ। যে ট্রাকগুলো পেঁয়াজ নিয়ে বেনাপোল সীমান্তে অপেক্ষা করছিল সেগুলোও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি। বৃহস্পতিবার জানা গেল সেগুলো নাকি বাংলাদেশে আসবে ।
এর দু’দিন আগে বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ ভারতে দেড় হাজার টন ইলিশ মাছ রপ্তানি করবে । প্রতি কেজি দশ মার্কিন ডলার । যেদিন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবরটি প্রকাশ হলো সে দিন ইলিশের প্রথম চালানে পঞ্চাশ টন ইলিশ বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলো। পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ আর ইলিশ রপ্তানি শুরু এই নিয়ে বাংলাদেশে মিডিয়া বেশ সরগরম। কারো কারো ধারণা ছিল পেঁয়াজ রপ্তানির বদলা হিসেবে বুঝি বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এমন পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা শিষ্টাচার বহির্ভূত । বাংলাদেশ কখনো এমনটা করেছে তার নজির নেই ।
অনেকেই জানে না পেঁয়াজ, তেল, আটার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ভারতীয় রাজনীতিতে খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কখনো কখনো সরকার পতনের কারণও হতে পারে । ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক রুচির শর্মা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক । তার লেখা বই ঞযব জরংব ধহফ ঋধষষ ড়ভ ঘধঃরড়হং এ ভারতের রাজনীতিতে পেয়াঁজ সহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দামের প্রভাব নিয়ে একটি পৃথক চ্যাপ্টারই আছে। তিনি লিখেছেন লবণ ও পেঁয়াজের মতো দ্রব্য ভারতীয়দের জাতীয় পরিচয়ের (ঘধঃরড়হধষ ওফবহঃরঃু) অন্যতম স্তম্ভ । ভারতীয়দের খাওয়ার টেবিল এই সবের উপস্থিতি ছাড়া চিন্তাই করা যায়না । শর্মা ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে পেঁয়াজের মতো জাতীয় ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী বলে মনে করেন । ২০১০ সালে পেয়াঁজের মূল্য বৃদ্ধি পেলে সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় আর সাথে সাথে ‘শত্রু দেশ’ পাকিস্তান হতে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়। জাতীয় স্বার্থে অনেক সময় শত্রুমিত্রের ব্যবধান সরু হয়ে যায় ।
বাংলাদেশে এবার একেবারে চটজলদি পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পেছনেও ভারতের রাজনীতির প্রভাব প্রকট। এমনিতে এবার উত্তর-পশ্চিম ভারতে ভারী বর্ষণের কারণে পেঁয়াজের উৎপাদনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভারতের বেশিরভাগ পেঁয়াজ এই সব অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। দক্ষিণ ভারতেও হয়। সেখানেও বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে । গত বছরও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে বাংলাদেশে রাতারাতি পেঁয়াজ আমদানিকারকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পেঁয়াজ গুদামজাত শুরু করে। সরকার যখন বিকল্প উৎস হতে বিমানে করে পেঁয়াজ আনা শুরু করলো তখন আবার পেঁঁয়াজের দাম পড়তে শুরু করে। অনেক আড়তদারের গুদামজাত করা পেঁয়াজ গুদামেই নষ্ট হয় ।
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক সভায় যোগ দিতে চার দিনের সফরে দিল্লী গেলেন । সে সময় তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের সামনে এই পেঁয়াজ রপ্তানি বিষয়ক সৃষ্ট জটিলতা তুলে ধরেন এবং বলেন, তিনি নিজে এখন আর রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করেন না। তাঁর এই বক্তব্য ছোট হতে পারে তবে খোদ ভারতের রাজধানীতে বসে এই কথা বলার মধ্যে এক ধরণের কূটনীতি আছে যা ভারতকে বিব্রত করেছিল ।
কেন হঠাৎ ভারতের এই আচমকা পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ? ১৬ সেপ্টেম্বর কোলকাতা হতে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা লিখছে, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের চাষিদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম অসন্তোষ কারণ পেঁয়াজ রপ্তানি না করলে তাদের বিরাট লোকসান । পত্রিকাটি আরো লিখেছে ‘মোদী সরকার বিহার ভোটের আগে পেঁয়াজের দাম নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ।’ ঘুরে ফিরে আবার ভারতের রাজনীতিতে পেঁয়াজ । বিবিসিও তাদের সংবাদ বিশ্লেষণে একই কথা বলছে ।
বাংলাদেশ এই হঠাৎ সৃষ্ট পেঁয়াজ সংকট মোকাবেলায় কি করবে? গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়তো কিছুটা চালাক হয়েছে । ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ পেঁয়াজ উৎপাদনকারি দেশের সাথে যোগাযোগ করেছে যার মধ্যে আছে মিশর, চীন, তুরস্ক, মিয়ানমার আর পাকিস্তান। বৃহস্পতিবারের খবর হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদেশ হতে কুড়ি হাজার টন পেঁয়াজ আসছে। পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি এবারও প্রয়োজনে বিমানে করেও পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত হতে পারে। সংকট সমাধানে এমন সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনা এর আগেও দিয়েছেন। ভারতের একটি স্লোগান হচ্ছে ‘প্রতিবেশী প্রথম’ । এই স্লোগান অনেক সময় দেখা যায় কাজ করে না । শেখ হাসিনার স্লোগান হচ্ছে ‘দেশের মানুষ প্রথম’। এটি তিনি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন ।
এবারের পেঁয়াজ নিয়ে ভারত সৃষ্ট হঠাৎ সংকট এবারই শেষ হয়ে যাক । এই সমস্যা বাংলাদেশের পক্ষে সমাধান করা কঠিন নয় । স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে বাংলার কৃষকরা দশ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করতো যা প্রয়োজনের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ । তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি । বর্তমানে দেশের কৃষি জমি প্রায় পনের ভাগ কমে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলার কৃষকরা বছরে গড়ে সাড়ে ত্রিশ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি ধান উৎপাদন করে । বাংলাদেশ বিশ্বে এখন চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারি দেশ । তাহলে সেই দেশের কৃষকরা বাংলাদেশের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারবে না? কেন সব সময় এই সামান্য পেঁয়াজের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে? কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্য দাম নিশ্চয়তায় বন্ধ করা হোক এক বছর পেঁয়াজ আমদানি । আগাম ঘোষণা দেয়া হোক এই বছর পেঁয়াজ আমদানি হবে না, কোন দেশ থেকে না। দেখা যাবে যে কৃষক কখনো পেঁয়াজ উৎপাদন করেনি তারাও পেঁয়াজ বপন শুরু করছে । তাদের দেয়া হোক স্বল্পমূল্যে পেঁয়াজের বীজ । যত রকমের সহায়তা বা প্রণোদনা প্রয়োজন তা দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করা হোক । যে সব এলাকায় পেঁয়াজ বা পচনশীল সব্জি উৎপাদন হয় সেই সকল এলাকায় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা হোক বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করার জন্য। তাদের দেয়া হোক বিশেষ সুবিধা । শেখ হাসিনার সরকারের আমলে কৃষিতে যে একটা বিপ্লব এসেছে তা তাঁর চরম সমালোচকও স্বীকার করবেন । তাঁর কেবিনেটের যে ক’জন যোগ্য মন্ত্রী আছে তাদের অন্যতম কৃষিমন্ত্রী । তাঁর পড়ালেখা কৃষিতে । তিনি বলতে পারবেন কেমন করে ফি বছর এই পেঁয়াজ বিষয়ক জটিলতা এড়ানো সম্ভব । কৃষি অর্থনীতিতে পেঁয়াজ তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য নয় ঠিক কিন্তু বাঙালির পাতে যে তরকারি পড়ে তাতে পেয়াঁজের ঝাঁজ থাকবে না তা চিন্তা করতে পারেন না অনেকে। তাদের স্বস্তি দেয়াই সরকারের কাজ । সরকারতো ভারতের তুলনায় অনেক ভাল আছে । এই দেশে পেঁয়াজের দামের সাথে অন্তত রাজনীতির সাথে তেমন কোন সম্পর্ক নাই । কোন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে সরকার তা স্বাভাবিক করতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে । খোলা বাজারে তা বিক্রিও শুরু হয় ।
সবশেষে অনেকে মন্তব্য করেছেন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পাল্টা হিসেবে ভারতে ইলিশ পাঠানো বন্ধ করা উচিত ছিল। গত আট বছর এই দেশের কোন ইলিশ ওপার বাংলায় যায়নি । এবার যাচ্ছে । তাতে বাংলাদেশেরই লাভ। ভারতের সাথে আমাদের বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি । সেই ঘাটতি দূর করতে সম্ভব হলে শুধু ইলিশ কেন অন্য যে কোন জিনিসও রপ্তানি করা যেতে পারে। প্রথম চালানে যে পঞ্চাশ টন ইলিশ কোলকাতায় গিয়েছিল তা থেকে বৃহস্পতিবার কুড়ি টন কোলকাতার বাজারে আসার এক ঘণ্টার মধ্যেই শেষÑতেমন খবর দিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া বুধবার। অনেকে পদ্মার ইলিশের সাথে ছবিও তুলেছে আর সে ছবি ছেপেছে টাইম্স অব ইন্ডিয়া। বাজারভেদে প্রতি কেজি চৌদ্দশ রূপি হতে আড়াই হাজার। জয় আমাদের পদ্মার ইলিশ ।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক