সুপ্রভাত ডেস্ক »
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটিতে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং সাইপ্রাসও কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে; এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটিতে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১,১০০ ছাড়িয়েছে এবং আহত পাঁচ হাজার ৩শ’ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
তিনি বলেছেন, এটি ১৯৩৯ সালের পর থেকে তুরস্কের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর এতে ২৮১৮টি ভবন ধসে পড়েছে।
প্রতিবেশী সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮০০ হয়েছে এবং দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। হতাহতদের অধিকাংশই আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তারতুস প্রদেশের বাসিন্দা বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে আরও অন্তত ১৪৭ জন নিহত হয়েছেন বলে বিদ্রোহীদের উদ্ধারকারী দল হোয়াইট হেলমেট টুইটারে জানিয়েছে। এখানে আরও ৩৪০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে তারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার ভোরে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্প হয়। প্রবল শীতের মধ্যে ভোররাতে হওয়া এ ভূমিকম্পে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং সাইপ্রাসও কেঁপে ওঠে। অঞ্চলটির অধিকাংশ মানুষই তখন ঘুমিয়ে ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে শুরু হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তি গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীরে।
তারপর থেকে পরবর্তী ঘণ্টাগুলোতে অন্তত ২০টি পরাঘাত অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ছিল বলে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া থেকে শুরু করে ভূমিকম্পটি দক্ষিণে রাজধানী দামেস্ক পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে।
তুরস্ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধারকারীদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়ে সহায়তা করতে জনসাধারণকে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে।
ভূমিকম্পের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচ- শীতের মধ্যে তুষারে ঢাকা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়।
প্রবল ঝাঁকুনিতে বহু ভবন ধসে পড়েছে, সেসব ধ্বংসস্তূপে এখনও বহু মানুষ আটকা পড়ে আছেন।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস-এই ১০টি শহর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গণমাধ্যমে আসা ছবিতে দেখা গেছে, কাহরামানমারাস শহরে ধসে পড়া ভবনগুলোর চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে জীবিতদের খোঁজ করছে।
তুরস্কের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সানলিউরফার গভর্নর সালিহ আয়হান টুইটারে বলেছেন, আমাদের অনেক ভবন ধ্বংস হয়েছে।
তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১৯শ ছাড়িয়েছে
সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম আলেপ্পো প্রদেশে বহু ভবন ধসে পড়েছে বলে জানিয়েছে। দেশটির হামা প্রদেশের বেসামরিক পরিষেবা কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছে, সেখানেও বেশকিছু ভবন ধসে পড়েছে।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, লেবাননের রাজধানী বৈরুত এবং বন্দর শহর ত্রিপোলিতে ভূমিকম্পের কারণে লোকজন দৌঁড়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়, তাদের ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে আশঙ্কায় কেউ কেউ নিজেদের গাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
দামেস্কের বাসিন্দা সামের বলেন, দেয়ালে ঝুলানো পেইন্টিংগুলো পড়ে যায়। আমি আতঙ্কিত হয়ে জেগে উঠি। এখন আমরা সবাই দরজায় নিচে দাঁড়িয়ে আছি। উভয় দেশে শত শত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া জীবিতদের রক্ষা করতে উদ্ধারকারীরা কাজ শুরু করেছেন।
ভারি বৃষ্টি ও তুষারপাতের শঙ্কা
তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় আগামী কয়েক দিনে ভারি বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে এবং রাতের বেলা তা আরো কমে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
এমনকি ওই এলাকায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার গভীর তুষারে ঢেকে যেতে পারে। তুরস্কের উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় আরো বেশি তুষারপাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পাহাড়ে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে।
এদিন দুপুরে তুরস্কে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার দ্বিতীয় আরেকটি ভূমিকম্প হয়। যেটির উৎপত্তিস্থল ছিল দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান জেলা। দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানায় বিবিসি।
তুরস্কে প্রথম ভূমিকম্পে অন্তত ২ হাজার ৮০০টি ভবন ধসে পড়েছে। যার অর্থ হাজার হাজার মানুষকে হাড় হিম করা ঠা-ায় খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে।
এর অবস্থায় যদি বৃষ্টি ও তুষারপাত শুরু হয় তবে সেটাও অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। কারণ, ভোররাতে যখন ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল তখন মানুষজন প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি করে বাইরে বেরিয়ে যান। তাদের কারো কাছেই পর্যাপ্ত গরম কাপড় নেই।
দিয়ারবাকির শহরে এমনই একজন কুর্দি বয়স্ক নারী একটি ১২ তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের কাছে অপেক্ষা করছেন। যে ভবনের নিচ তলায় তার পরিবার বসবাস করতো।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘তারা নিচতলায় ছিল, ঘুমাচ্ছিল। আমি জানি না তাদের কাছে কেউ পৌঁছাতে পারবে কিনা…. যে পরিমাণ ঠা-া, আমার বাচ্চারা ধ্বংসস্তূপের নিচে জমে যাবে।
এই শহরে অন্তত সাতটি ভবন ধসে পড়েছে। ৩৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ১২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
২ বাংলাদেশি নিখোঁজ
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ খাহরামানমারাসের ভূমিকম্পে দুই বাংলাদেশি নিখোঁজ রয়েছেন। তারা হলেন, নূরে আলম ও রিংকু। তারা দুজনই শিক্ষার্থী। তারা যে ভবনে থাকতেন সেটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ইস্তান্বুলে বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল মোহাম্মেদ নুর-আলম বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ওই অঞ্চলের অনারারি কনসালের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি।
ওই অঞ্চলে গাজিয়ানতেপ শহরে বেশিরভাগ বাংলাদেশি অবস্থান করে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের কেউ কেউ সেখানে ব্যবসা করেন। কেউ এনজিওতেও চাকরি করেন। ওই অঞ্চলে প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি বসবাস করেন। তিনি বলেন, ভূমিকম্প যেখানে হয়েছে সেখানে আবহাওয়া খুব খারাপ এবং তুষারপাতের কারণে উদ্ধার অভিযান কিছুটা ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।