সুপ্রভাত ডেস্ক
চলতি বছর ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের মেয়র্স চ্যালেঞ্জে রেকর্ড সংখ্যক প্রস্তাবনা জমা পড়েছে। আগামী দিনের উদ্ভাবনী নগর পরিকল্পনা কেমন হতে পারে- তার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে শহরগুলোর আইডিয়া।
মহামারি থেকে উত্তরণের সেরা আইডিয়া জানাতে চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বের নানান প্রান্তের নগরপাল বা মেয়রদের চ্যালেঞ্জ করে ব্লুমবার্গের দাতব্য উদ্যোগ– ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস। এই আহবানে বিপুল সাড়া পড়েছে এবছর; প্রায় ৯৯টি দেশের ৬৩১টি শহর থেকে জমা পড়ে নতুন সব উদ্ভাবনী কৌশল ও পরিকল্পনা। ‘মেয়র্স চ্যালেঞ্জ‘ শীর্ষক এ প্রতিযোগিতায় আগে কখনোই এত বিপুল অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি।
আগামী সপ্তাহে ঘোষিত হবে বিজয়ী শহরগুলোর নাম, যেখানে স্থান পাবে মহামারির আঘাতে পর্যদুস্ত বছরগুলো থেকে উত্তরণে ৫০টি নগরের সাহসী পরিকল্পনা। উদ্ভাবনী পরিকল্পনা ও সঙ্কট সমাধানের অনন্য উপায়ের ভিত্তিতে ব্যতিক্রমী শহরগুলোকে বাছাই করবেন বৈশ্বিক একটি বিশেষজ্ঞদের প্যানেল। বাছাই হওয়া শহরগুলোকে তারপর ১০ লাখ ডলার মূল্যের ১৫টি পুরষ্কার জিততে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হবে।
তবে সেরা ৫০ ঘোষণার আগেই এবারের ৬৩১টি আবেদনকারী নগর কর্তৃপক্ষের সৃজনশীল ধ্যান-ধারণা ও প্রস্তাবনাগুলোর দিকে আলোকপাত করা যেতেই পারে। এবারে অর্ধেকের বেশি আবেদনই এসেছে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো থেকে। সবার প্রস্তাবনাকে একসঙ্গে দেখলে মহামারি থেকে পরিত্রাণে সাড়া বিশ্বের শহরগুলো যেসব দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে পারে তার একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে। যেমন; মহামারি মোকাবিলায় নগর কর্তৃপক্ষ কেমন ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং উত্তরণের কোন পর্যায়েই বা শহরগুলো আছে তা যেমন দৃশ্যমান হয়, তেমনি আগামীতে তারা কেমন সফলতা অর্জন করতে চায় বা কীভাবে সেলক্ষ্যে পৌঁছানোর আশা করছে, রয়েছে সে আলোচনাও।
স্বাভাবিকভাবেই এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নগর কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যখাতের নানা সমস্যা সমাধানেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেক বা ৩৩৭টি শহরের কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে তাদের নিজস্ব আইডিয়া জানিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২৭টি আইডিয়া জমা পড়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়ে। তারপর, ২২৬টি এসেছে সমতা ও সুশাসনে নিশ্চিতকরণে, জলবায়ু ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় আইডিয়া আসে ১৬৩টি।
আরও তৃণমূল পর্যায়ের নানা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছে আবেদনকারী শহরগুলো। যেমন; মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রস্তাব এসেছে ৫৭টি শহরের, বেকারত্ব সমাধানে ৩৮টির, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ৩৪টি, খাদ্য নিরাপত্তায় ৩২টি, নাগরিক পরিসর তৈরির ব্যাপারে ২৬টি, শিক্ষায় ২৪টি এবং ডিজিটাল বৈষম্য নিরসনে প্রস্তাব দেয় ২৩টি শহর।
ভৌগলিক অবস্থান ভেদেও স্পষ্ট হয়েছে নতুন কিছু প্রবণতা। যেমন; বিশ্বের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশেই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে নগরবাসী জনসংখ্যা বৃদ্ধির আভাস দেওয়া হয়েছে, তাই এ মহাদেশ থেকে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ শহর মৌলিক অবকাঠামো নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শহরগুলো অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর। বর্ণবাদী বৈষম্য নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তোলপাড় হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নগর কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে বেশি উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা আবেদনের ৬২ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গদের আর্থিক ক্ষমতায়নসহ সমস্যাটির নানা দিক সমাধানের আইডিয়া দেয়। অথচ, ২০১৮ সালে মেয়র্স চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়া মার্কিন শহরগুলোর মাত্র ৪ শতাংশ বর্ণবাদী বৈষম্য নিরসনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
তবে ব্লুমবার্গের মেয়র্স চ্যালেঞ্জ শুধু বড় বড় আইডিয়া জমা দেওয়ার লড়াই নয়, বরং প্রতিযোগিতাটি সমস্যা সমাধান, প্রতিক্রিয়া শক্তিশালীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নগর নেতৃত্বকে গভীরভাবে চিন্তায় উৎসাহিত করে থাকে। বাস্তব ভিত্তিক এমন চিন্তা ও পদক্ষপের ভিত্তিতে তারা আগামীদিনের বড় সমস্যা মোকাবিলায় নিজেদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা কীভাবে তুলে ধরেন সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর চলতি বছর জমা পড়া আবেদনগুলো এখানেই চমৎকার কিছু প্রস্তাবনা ও প্রকৃত কৌশল ব্যাখ্যা করেছে। মহামারি পরবর্তী বিশ্বে নগর উদ্ভাবনার হৃৎস্পন্দন পরিমাপের উৎসই যেন এসব। চলতি বছরের এমন চারটি মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরা হলো;
প্রথমত, নগর কর্তৃপক্ষ তাদের চিরায়ত দায়িত্ব ও ক্ষমতার বাইরেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে: অনেক দেশের জাতীয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার যখন মহামারি মোকাবিলায় সঠিক প্রতিক্রিয়া নিতে ব্যর্থ হয়, তখন নগরবাসীর খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনের নেতাদেরই দায়িত্ব নিতে হয়েছে, অথচ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে একথা তারা কোনোদিন ভাবতেও পারেননি। নগরপিতারা এখন এসব জরুরি সহায়তা কর্মসূচির আকার বৃদ্ধি করতে চান। যেমন, কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা মহামারির মধ্যে সংসারের সিংহভাগ দায় কাঁধে নিতে বাধ্য হওয়া নারীদের বড় আকারের সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আবার, স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখতে নিজস্ব প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছে ভিয়েতনামের দানাং শহর। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন অনাহার মোকাবিলায় ‘স্যুপ কিচেনে’র সংখ্যা বাড়ানোর আশা করছে।
দ্বিতীয়ত, অধিবাসীদের সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ: প্রতিযোগিতায় আবেদনকারী প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শহর জনগণের অংশগ্রহণ, সহ-পরিকল্পনা এবং পরামর্শকে তাদের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের সফলতা অর্জনের মূল পাথেয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার দিকটিও নিরসন করতে চান। আস্থাহীনতার এ প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও, গেল বছর মহামারি হানা দেওয়ার পর- তা আশঙ্কাজনক মাত্রায় পৌঁছে যায়। যেমন; যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিন্স নগর প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পর্ক জোরদারের ওপর নতুন করে গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, এর মাধ্যমে কোনো প্রকল্প সফল হলে আস্থা যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনি ব্যর্থ হলে আস্থা সঙ্কটও ঘটতে পারে। কানাডার ক্যালগেরি শহরের নেতৃবৃন্দ স্থানীয় আধিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আবাসন নির্মাণ কৌশল তৈরি করতে চান।
তৃতীয়ত, শহরগুলো আরও বাস্তবধর্মী উপায়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহী হচ্ছে: এর আগের মেয়র্স চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়া শহরগুলো নাগরিক পরিষেবার নানা খাতে প্রযুক্তির উচ্চাভিলাষী ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়ে, যেমন; স্মার্টফোন অ্যাপ চালু করলেই কোনো সমস্যার সমাধান হবে, এমন প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু, এবার তারা শুধুমাত্র প্রয়োজনেই প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে, যার মাধ্যমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগানো হবে। যেমন; এর আগে নেদারল্যান্ডের রটারড্যাম আর্থিকভাবে দুর্বল সঙ্গতির বাসিন্দাদের চিহ্নিত করে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক থাকা প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাকরি দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। এবছর, রটারড্যামের পৌর প্রশাসন কোম্পানিগুলোর সামাজিক প্রভাব নিরূপণের একটি ‘ডিজিটাল টোকেন’ চালু করে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দিতে চাইছেন।
সর্বশেষ দিকটি উঠে এসেছে নগর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা কৌশল গ্রহণের দিক থেকে: যেমন; সম্পূর্ণ নতুন কিছু উদ্ভাবনের চাইতে দুই-তৃতীয়াংশ শহর বিদ্যমান আইডিয়াকে নতুনভাবে বা আংশিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রহণ করেছে। দ্রুতগতির এক সঙ্কটের কালে এমন আচরণই সঠিক। নগর নীতিমালা বিশেষজ্ঞ চার্লস লিডবিটার ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কোভিড-১৯ মোকাবিলার লড়াইকে পাশাপাশি তুলনা করে এমন কথাই বলেছেন। তিনি বলেন, “সঙ্কটকালে উদ্ভাবনের সবচেয়ে সঠিক ও কার্যকর উপায় হচ্ছে; নতুন করে কিছু শুরু করার চাইতে বিদ্যমান সম্পদকে সৃষ্টিশীল উপায়ে কাজে লাগানো।”
কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন ২০০ নতুন ব্যবসা চালুর প্রস্তাবে এই পরামর্শটি প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও রাজ্যের আর্কন শহর। নগর কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের মেডিকেল রাউন্ড মডেলটির অনুকরণে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে, জাম্বিয়ার লুসাকা শহর অ্যালকোহল থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং বর্জ্য থেকে শক্তি ও উর্বর জৈব সার উৎপাদনে একটি ছোট্ট প্রকল্পের পরিকল্পনা জমা দিয়েছে।
এভাবেই চলতি বছর অনেক বেশি বাস্তবমুখী ও সৃজনশীল উদ্ভাবনার কথা উঠে আসে। খুব শিগগির প্রকাশ হতে চলা ৫০টি চ্যাম্পিয়ন শহরের তালিকা নগর নেতৃত্বের আগামীদিনের প্রস্তুতিকেই তুলে ধরবে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন/ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত