বৈচিত্র্যকে গ্রহণে সামাজিক মানসিকতা বদলেছে

সম্প্রীতি উৎসবে শিক্ষা উপমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘সমাজে অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করেই আমাদের এগুতে হয়। বৈচিত্র্যকে গ্রহণে সামাজিক মানসিকতা বদলে গিয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা এখন সামাজিক স্বীকৃতি পায়।’ ইউএনডিপি আয়োজিত সম্প্রীতির উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গতকাল ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ইউএনডিপি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ‘সম্প্রীতির উৎসব’ নামে দিনব্যাপী এই আয়োজন। একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ বির্নিমাণ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাংবিধানিক ঘোষণা সমুন্নত রাখার প্রত্যয় নিয়ে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের নরওয়ে দূতাবাস এবং আইসিটি বিভাগের সহায়তায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি’র-(ইউএনডিপি) ‘পার্টনারশিপ ফর এ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ (পিটিআইবি) প্রকল্পের ‘ডাইভারসিটি ফর পিস’ এটুআই-এসপায়ার টু ইনোভেট-ইউনেস্কো, একশনএইড বাংলাদেশ, ইনস্টিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), দি এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ নারীপ্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আরও বলেন, ‘কুপমণ্ডুকতায় ভরা পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজের বীজবপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁর সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে দেয়নি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। সহনশীলতা ও মুক্তচিন্তার জন্য এ উপমহাদেশ বহু আগে থেকেই বিখ্যাত। আমাদের যে বহু শতকের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ঐতিহ্য তা ধংস করা হয়েছে উপনিবেশিকতার মাধ্যমে। তারা আমাদের মূল্যবোধের ওপর অন্য মূল্যবোধ চাপাতে চেয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও ছিল সম্প্রীতিরক্ষা ও বৈচিত্র্যরক্ষার এক সংগ্রাম। আমাদের সরকার সব সময় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির উদ্যোগ নিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সহনশীলতা ও ভিন্নতাকে গ্রহণের মানসিকতা অবশ্যই আমাদের তরুণদের থাকতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এটাই।’ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থিতিশীলতায় যেন কোনো হুমকি না আসে সে বিষয়ে আমরা সচেতন। ‘বাংলা হবে আফগান’ এ স্লোগান যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। সেটা না করলে দেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তানের পথে যাবে। যেসব দল ও সামাজিক শক্তি সহনশীলতা ও সম্প্রীতির সাথে আছেন, তাঁদের নিয়েই আমরা দেশ পরিচালনা করব।’
বিশেষ অতিথি নরওয়ের রাষ্ট্রদূত স্পেন রিকটার এসভেনডসেন বলেন, ‘অসাধারণ এক ধারণা সম্প্রীতির উৎসব। সম্প্রীতি ও সহনশীলতা খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। ভিন্নতাকে মেনে নেয়া হলো সহনশীলতা, এটা কঠিন কাজ। অনুশীলনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য সম্প্রীতি প্রয়োজন। শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য সম্প্রীতি প্রয়োজন। আমরা দ্বিধায় ভুগি টলারেন্স নিয়ে। সবার ভিন্নমতে আমরা একমত হবো, তা নয়। কিন্তু অন্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ দিতে হবে।’
বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের লিখিত বক্তব্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার আশা ছিল সকল ধর্মবর্ণজাতির মানুষের জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবাইকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব।’ অপর বিশেষ অতিথি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘সম্প্রীতির উৎসব বেশি করে হওয়া দরকার। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার চট্টগ্রাম। এখানে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করছেন। জাতির পিতা অসাম্প্রাদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের নীতি অনুসরণ করছেন। এই প্রযুক্তির যুগে মিস ইনফরমেশন অহরহ দেখতে পাই। যেকোনো তথ্য সোশাল মিডিয়াতে আসলেই সেটাকে সত্য বলে ধরে নেয় মানুষ। যা নানা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন।’
বিশেষ অতিথি চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্যি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়ানো হয়। যাঁরা এসব করেন , তাঁরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু তাঁরা মনে করেন তাঁদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুরা আছে। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। আমরা চাকমা সার্কেল চেষ্টা করছি সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে সকল ধর্মের মানুষের যাতে সহাবস্থান সম্ভব হয়। পাহাড়ে বাঙালিসহ সকলকেই সম্প্রীতির বন্ধনে রাখার চর্চা অব্যাহত আছে।’
বিশেষ অতিথি ইউনেস্কো’র অফিসার ইনচার্জ সুসান ভাইজ বলেন, ‘ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে শেখানো হয়, যা আমাদের মতো নয়. তা খুব বিপজ্জনক। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি আসবে না। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে ও সচেতন থাকতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা কাজ করছি।’
জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের উপআবাসিক প্রতিনিধি সোনালি দয়ারাত্নে। বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য নিরুপা দেওয়ান, ইনস্টিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি)-এর নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, ইউনাইটেড থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাকশন-(উৎস)’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল যাত্রা। উৎসবের উদ্বোধনীপর্বে সমাপনী বক্তব্য রাখেন পিটিআইবি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক রবার্ট স্টোলম্যান। এ পর্বে চাকমা সমাজের উভাগীত, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সঙ্গীত, মেয়েদের মার্শাল আর্ট, পাপেট শো এবং ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির সদস্যদের গীতিনাট্য পরিবেশিত হয়। দ্বিতীয়পর্বে সহনশীলতার প্রতি তরুণদের ভাবনা শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সহনশীলতা কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে, সে সম্পর্কে তরুণদের মতামত নেয়া হয়। এ পর্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক-এর রিসার্চ ম্যানেজার আবু সাইদ মো. জুয়েল মিয়া।
সমাপনীপর্বে নাটক ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ মঞ্চস্থ হয়। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করে ‘টঙের গান’ ও সাঁওতাল ব্যান্ড ‘আংরা’। দিনব্যাপী আয়োজনে আরও ছিল চিত্রপ্রদর্শনী, পাপেট শো ও এম্পেথি গেম।