মহিউদ্দিন আহমেদ »
চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট শুধু একটি বিস্কুট নয়, এটি এই শহরের সংস্কৃতিরও অংশ। প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ বছর ধরে এই বিস্কুট চট্টগ্রামবাসীর নিত্য সঙ্গী! বেলা বিস্কুট প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার না করে পারছিনা। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, কোনো এক সকালে অফিসের ক্যান্টিনে নাস্তা করছিলাম। এক বিদেশি কলিগ পরিচয় করিয়ে দিলো ‘ভেজিমাইট’ নামে একধরনের ব্রেড স্প্রেড এর সাথে , অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক সেই লেভেলের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। অস্ট্রেলিয়ানদের এইটা ছাড়া নাস্তাই হয় না। আমাকে কনভিন্স করলো যেই কথা সেই কাজ, বাড়ি ফেরার পথে এক বয়াম কিনে নিলাম। পরদিন পাউরুটি টোস্ট করে কথা মতো লাগিয়ে এক কামড় দিলাম তারপর বাকিটা গার্বেজে! খাওয়াটা কি এতোই খারাপ? না। কাজে গিয়ে কলিগকে অভিজ্ঞতার রিপোর্ট জানালাম শুনে মুচকি হেসে বললো ‘Actually, you have to be brought up with it’! গল্পটার কারণ হলো বেলা বিস্কুটের ক্ষেত্রে একই এক্সপ্রেশন পেয়েছি চট্টগ্রামে বেড়ে না উঠা মানুষদের খাইয়ে। চা’য়ে চুবাইয়া চুবাইয়া বেলা বিস্কুট না খাইয়া যে বড় হৈছে সে বেলা’র মর্ম বুঝিবে না । ‘Actually, you have to be brought up with it’.

এটাই মোদ্দাকথা। বলা হয়, ব্রিটিশ আমলে যখন চট্টগ্রাম বন্দরনগরী হয়ে উঠছিল, তখন বিদেশি ব্যবসায়ী ও সৈন্যদের প্রভাবে এখানে প্রথম বেকারি স্থাপন হয়। কথিত আছে, ব্রিটিশদের নাস্তা সরবরাহের জন্য আসাম থেকে মাইগ্রেট করে আনা হয় বেকারি আইটেম বানানোর একজন কারিগর যার হাত ধরে সেই সময়ের অন্যতম বিখ্যাত বেকারি হয়েছিল গনি বেকারি, যা চন্দনপুরা এলাকায় অবস্থিত। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আব্দুল গণি সওদাগর, যিনি সম্ভবত ১৮০০-এর দশকে এই বিস্কুট তৈরি শুরু করেন। বেলা বিস্কুটের নাম নিয়ে বিভিন্ন গল্প আছে। অনলাইন ঘেঁটে জানা যায় কেউ বলেন, এটি ‘বেলায়েত আলী’ নামের এক বিক্রেতার নাম থেকে এসেছে, আবার কেউ মনে করেন ‘বেলা’ মানে বিকেল তথা বিকেলের চা-এর সঙ্গে খাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ায় এর নাম রাখা হয় বেলা বিস্কুট। এই বিস্কুটের বিশেষত্ব হচ্ছে চা’য়ে ডুবানোর সাথে সাথে ভিতরে হাজারো প্রকোষ্টে চা ঢুকে মুখে এক মোলায়েম আমেজ সৃষ্টি করে, যার স্বাদ হালকা মিষ্টি। চট্টগ্রামের মানুষ এখনো বিকেলের চায়ের সঙ্গে বেলা বিস্কুট খেতে ভালোবাসে।
পুরোনো দোকানগুলোর মধ্যে গনি বেকারি আজও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই বেকারির নামে ওই জায়গার নাম এখন ‘গনি বেকারির মোড়’ বলে পরিচিত। তারা এখনো পুরোনো ধাঁচে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা পদ্ধতিতেই বেলা বিস্কুট তৈরি করে। বেলা বিস্কুট একসময় সৈন্যদের রেশন, ব্যবসায়ীদের উপহার, এমনকি বিদেশে পাঠানো হতো পরিবারের জন্য। আজও বিদেশে থাকা অনেক চট্টগ্রামবাসী দেশে ফিরলে এই বিস্কুট সঙ্গে করে নিয়ে যান, যেমন আমি নিয়ে যাই কিছু দিয়ে যাই। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্র্যান্ডের বিস্কুট বাজারে এসেছে, তবুও চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুট এখনো এক অনন্য ঐতিহ্যের প্রতীক, এমন এক স্বাদ, যা সময়কে পেরিয়েও টিকে আছে চট্টলার সংস্কৃতির অংশ হয়ে এই শহরের হৃদয়ে। হয়তো কোন এক যুগে কোন একদিন বিকেলের আড্ডায় বাজবে এক অদৃশ্য নস্টালজিয়ার সুর ‘চা আর বেলা বিস্কুট ছাড়া বিকেলটা অসম্পূর্ণ।’
লেখক : আলোকচিত্রী, বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন।