স্বপন শর্মা »
বাড়ির পেছনে, গোয়ালঘরের পাশে এখনো একটা পুরনো গাড়ি পড়ে আছে। ধুলোমাখা, ছেঁড়া দড়ি। মাকড়সার জাল জমেছে তার গায়ে। যেন সেই বিয়ারিং গাড়িটি নিঃশব্দে বলে যাচ্ছে কোনো এক সময়ের গল্প। এক মায়ের ভালবাসা। এক শিশুর ছোট্ট রাজ্য। এক জীবনের খুব গভীর অনুভব।
স্বপন ফিরে এসেছে গ্রামে। একমাত্র মা, নমিতা বালা। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। শহরের কর্মব্যস্ততা থেকে ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছে সে। ছেলেবেলায় যে উঠোনে সে উল্টে-পাল্টে খেলতো। সেই উঠোনটা আজ যেন অনেক ছোট মনে হয়। একসময় যে মাঠ তাকে ডাকতো। সেই মাঠ এখন ঝোপঝাড়ে ঢাকা।
মা বিছানায় শুয়ে আছেন। মুখে একরাশ শান্তি। চেহারায় বয়সের ভাঁজ। চোখে আছে সেই পুরনো চেনা আলোর রেখা। মায়ের হাত ধরে, স্বপন চুপ করে পাশে বসে থাকে। কোনো কথা হয় না প্রথমে। শুধু এক ধরনের নীরব আত্মিক যোগাযোগ। যা ভাষার চেয়ে অনেক গভীর। মা হঠাৎ বলেন,
“তোর সেই গাড়িটা এখনো আছে রে।”
“কোন গাড়ি?”
“সেই বিয়ারিং গাড়ি। গাছের ডালে বানিয়েছিলাম। তুই তখন কেবল হাঁটতে শিখেছিস। বলতিস, ‘গাড়ি চাই, মা। গাড়ি।’ আমি আর তোর বাবা মিলে বানালাম।”
স্বপনের মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে। তার বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠে। সে জানে, তখন তাদের কিছুই ছিল না। খেলনা কেনার সামর্থ্য তো দূরের কথা। পায়ের জুতো জুটত কেবল স্কুলে যাওয়ার সময়। মা যে জিনিসটা দিয়েছিলেন। সেটা যে কেবল খেলনা নয়। সেটা ছিল ভালোবাসার তৈরি এক রাজসিংহাসন।
মা বলেন,
“তোর মুখে সেই হাসি আমি আজও ভুলতে পারি না রে। তুই বলতিস, ‘আমি রাজপুত্তুর।’ আমি তোকে টেনে নিয়ে যেতাম সারা পাড়া ঘুরে। কে বলবে আমাদের বাড়িতে খেলনা নেই!
স্বপনের চোখে জল চলে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়। পেছনের গোয়ালঘরের দিকে হাঁটে। সত্যিই, সেখানে এখনো সেই গাড়িটি পড়ে আছে। সময়ের সাথে তা নষ্ট হয়ে গেছে। স্মৃতির ভারে তা আজও গর্বিত। সে ধীরে ধীরে গাড়ির গায়ে হাত রাখে। বেয়ারিংগুলোয় একটা চেনা উষ্ণতা যেন ভেসে আসে। মরচে পড়া বিয়ারিং ঘোরানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলো। বিকেলের আলোয় মা দড়ি বাঁধে, একটা পিড়ি দিয়ে তাকে বসে দিতেন গাড়ির উপর। চারদিকের ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে তাকিয়ে থাকত। সে গাড়িতে বসে হাত তুলে রাজপুত্রের মতো সালাম দিত। মা হাসতেন,
“এ আমাদের রাজপুত্তুর! ছাদ খোলা গাড়িতে করে যাচ্ছে রাজসভায়!” মাঠে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে মা বলতেন, “এখানে তোর রাজ্য, ওখানে নদী, আর ওই যে তালগাছ, ওটা তোর প্রাসাদ।”
সে বিশ্বাস করত। সেই ছোট্ট মন দিয়ে ভাবত, হ্যাঁ, সত্যিই সে রাজপুত্র। তার মায়ের চোখের চাহনি, গলার সুর, আর সেই গাড়ির ছোট্ট কাঁপুনিতেই সে অনুভব করত নিজের রাজত্ব।
শহরে এসে বড় হয়ে উঠতে উঠতে সেই রাজ্য হারিয়ে ফেলে। চাকরি, অফিস, টার্গেট, অ্যাপ্রাইজাল, ইএমআই, সন্তানের স্কুল। সব কিছুর মাঝে সেই গাড়ি কোন এক সময় ভেসে চলে গিয়েছিল স্মৃতির জোয়ারে। আজ আবার সেটা ফিরে এল। রাতের খাবারের পর মা ঘুমিয়ে পড়েন। স্বপন চুপিচুপি বাইরে যায়। বিয়ারিংগুলো ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে। কিছুক্ষণের জন্য যেন সময় থমকে যায়। পরদিন সকালে, গ্রামের শিশুরা খেলছে মাঠে। স্বপন গাড়িতে ছেলেকে বসিয়ে দড়ি হাতে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে পাড়ার রাস্তা ধরে। একজন বলে ওঠে, “তোমার ছেলে খুব আনন্দ পাচ্ছে রে, স্বপন!” সে মুচকি হেসে বলে, “আনন্দ তো আসলে ওর নয়, আমার। আমি আবার একটু রাজপুত্র হলাম বুঝলে!”
হঠাৎ দূর থেকে কেউ বলে ওঠে,
“ওই তো সেই বিয়ারিঙের রাজপুত্র! নমিতা বালার রাজপুত্র আবার ফিরে এসেছে!”
স্বপন থেমে যায়। বুকের ভেতর যেন কিছু একটা হু হু করে ওঠে। সে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশটা আজ অনেক খোলা লাগছে, মায়ের মুখের মতো শান্ত, প্রশান্ত। সেই ভাঙা গাড়িতে তার সন্তান খেলছে। বিয়ারিঙের দড়িটা আজও যিনি টানেন, তিনি এক মা। কয়েক যুগ, এক ভালোবাসা। যার কোনও দাম হয় না। যার বিকল্প হয় না।