নূর নবী আহমেদ »
ভোরের নবজাতক সূর্য পূর্বদিকে উঁকি দেয়; ধীরে-ধীরে সকালে কৈশোরে পা রাখে; দুপুরে উদ্দাম যৌবন অতিক্রম করে অল্প-অল্প করে রশ্মি বিকিরিত করে বিকেলে বার্ধক্যে পরিণত হয়ে সন্ধ্যায় তার আয়ু শেষ হয়। পরেরদিন তার পুনর্জন্ম হয়; এভাবেই প্রকৃতির নিয়মে সূর্য তার শক্তি ফিরে পায়। বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ইউসুফের চোখে ও মগজে তকতক করে তা ভাসতে থাকে। মাত্র দুটো চোখ তার যাতে কফোঁটা জল আর তাতে শতাব্দীর এই নিয়ম অনবরত বসত করে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি একা। উচ্চশিক্ষিত তিন ছেলে জাপানে বসবাস করছে। বাড়িতে যে কজন ভাতিজা আছে তারা শুধুমাত্র একটাই প্রার্থনা করে এই বুড়ো ভেজালের উপদ্রব থেকে কীভাবে ও কখন মুক্ত হওয়া যায়। ইউসুফের ছেলেরা কখনো এই দেশে আসবে না- এটা নিশ্চিত। তাই ইউসুফমুক্ত বাড়ি মানে বিনা পরিশ্রমে, বিনা কষ্টে তার ভাতিজাদের উর্বর ধানী জমিসহ উপজেলা শহরের একতলা বাড়িটির মালিক বনে যাওয়া।
এই কয়েক বছরের মধ্যে ইউসুফের মানসিক অবস্থা চরম খারাপ বলা যায়। একধরনের পাগলের মতো। এই অবসর বয়সে এসে মন উজাড় করে কথা বলার মতো কেউ নেই; সারাক্ষণ ভাতিজাদের কথার অদৃশ্য আঘাত, তার সাথে ভালো খাবারের অভাব; সব কিছু মিলে একাকিত্বের অদৃশ্য কারাগারে বন্দি সে।
কয়েকদিন হলো অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ইউসুফ বাড়িতে নেই। তা নিয়ে কেউ তেমন কষ্ট পাচ্ছে না বা তার বাড়িতে থাকার একান্ত প্রয়োজন তা কেউ মনে করছে না। অথচ এই বাড়ির মালিক সে। তার ছোটভাই ও ছোটভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভাতিজাদের নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করেছে সে।
লোকটির শরীরে তেমন শক্তি নেই, যতোটা থাকলে কাজ করে খাওয়া যায়, ঠিক ততোটা। কোনোভাবে হেঁটে চলে মাত্র, হেঁটে-হেঁটে এই বাজারের প্রত্যেকটা দোকানির কাছে হাত পাতে। দোকানিরা কোনো কিছু না দিয়ে লোকটিকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কুকুরকেও এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয় না। অথচ বৃদ্ধলোকটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাজারে আগত এই ধরনের বৃদ্ধলোকদের দোকানিরা পাগল নামে ডাকে। এই বাজারে মানুষ নামক অনেক পাগল আসে। অনেক পাগল এখান থেকে চলে যায়। কেউ তাদের খোঁজখবর রাখে না। এই বৃদ্ধ লোকটির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না তা। বৃদ্ধলোকটি কখন যে এ বাজারে এসে ঠাঁই নিয়েছে কেউ তা জানেও না, বলতেও পারে না।
বাজারের সব ইঁদুরের লক্ষ্যবস্তু যেন সুজাতের দোকান। প্রায় প্রতি রাতেই কিছু না কিছু ইঁদুরে কাটছে। আজকে বাজারবার। তাই সকাল থেকেই সবকিছু পরিষ্কারের কাজে নেমেছে সুজাত। নাবিস্কো কোম্পানির প্রায়য় এক কার্টন গ্লুকোজ বিস্কুট নষ্ট করেছে ইঁদুরের দল।
‘উন্দুরের কাওরা বিস্কুট কী হাগলরে দিতাম না হালাইয়া দিতাম? একজন মানুষ হে হাগল হোক আর বকরি হোক তারে উন্দুরের কাওরা বিস্কুট দেওন মানে তারে চুডু করা’। তাই দৃঢ়ভাবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ‘না হাগলরে না দিয়া বেক মঅলাসহ ডাসবিনো হালাইয়া দিই’।
দুপুরের রোদের তীব্রতা বাড়ার সাথে-সাথে পাগলের পেট নামক দানবটা শিকারের জন্য হিংস্র হয়ে ওঠে।
বাজার যখন জমে ওঠে বৃদ্ধলোকটি ডাস্টবিন থেকে ফেলে দেয়া বিস্কুটসহ আরো অনেক পচা-বাসি খাবার খেয়ে পেট নামক দানবকে শান্ত করে।
স্কুল ফাঁকি দিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা যখন নজরুলের দোকানে খেলতে আসে, তখন সে মনের আনন্দে প্রশান্তি ও তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। ছেলেদের উচিত নিয়মিত স্কুল ফাঁকি দেওয়া আর নজরুলের দোকানে ক্যারাম খেলা চালু রাখা। স্কুল চলাকালীন ক্যারাম খেলা হলে দোকানের সামনের ঝাঁপ বন্ধ রাখতে হয়। নজরুল তার দোকানের সামনের তিনটি ঝাঁপ একদম বন্ধ রাখে আর পিছনের খুপড়ি দরজাটা অল্প করে খোলা রাখে। স্কুলপড়ুয়া ফাঁকিবাজ ছেলেরা ক্লাস বাদ দিয়ে এই দোকানে প্রায় নিয়মিত ক্যারাম খেলায় মেতে ওঠে। খেলার একটাই শতর্; তা হলো কোনো কথা বলা যাবে না। এতে নজরুলের বাণিজ্যিক দোকানের প্রতিনিয়তই উন্নতি হচ্ছে।
মঙ্গলবারে কোনো বাজার বসে না। তাই দুপুর টাইম স্বচ্ছ নীরব। নজরুলের দোকানে সকাল সাড়ে দশটা থেকেই ক্যারাম খেলা চলছে। হঠাৎ অন্যরকম শব্দ হয় দোকানের বাইরে। দোকানের ভিতর কিছু সময়ের জন্য সবাই আঁতকে উঠে এবং তারপর চুপ করে। অবস্থা এমন যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো। নজরুল দোকানের ক্যাশ-কাউন্টার থেকে ওঠে স্বাভাবিক হয়ে সামনের মাঝখানের ছোট ঝাঁপটা খুলে প্রথমে সামনে তাকায়, পরেরবার বাঁয়ে এবং সবশেষে ডানে। তখন দৃশ্যটা এমন যে, বৃদ্ধলোকটি দোকানের পাল্লা ধরে ওঠার চেষ্টা করছে। আসলে দুর্বল শরীর নিয়ে ধুঁকে-ধুঁকে এই দোকানেই আসছিল সে। তবে কলার খোসায় পা রাখলে পড়ে যায়। নজরুল তাকে দেখামাত্রই পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে যায় ইচ্ছে হয় ফুটবলটাকে লাথি দিয়ে বাজারের ওই মাথায় পাঠিয়ে দিতে। রক্ত মাথায় নজরুল একটু এগিয়ে এসে দেখে লোকটির নোংরা শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তাই তার কিঞ্চিত দয়া হয়। বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়ে নজরুল বলে, ‘যা এইন তো’। এই বলে সে দোকানের ভিতরে চলে যায়। বৃদ্ধলোকটি উঠতে পেরেছে কি না কিংবা দোকান থেকে চলে গিয়েছে কি না তা নজরুল আর জানার চেষ্টা করেনি।
বাজারের পশ্চিম প্রান্তে একদম ট্রলার ঘাট সংলগ্ন জায়গাটা, কয়েক বছর আগে যেখানে বসে নিয়মিত তাসখেলা হতো, সময়ের বিবর্তনের সাথে সে জায়গায় এখন উঠতি বয়সের ছেলেরা বসে দিনরাতে হাবজি ফ্রি-ফায়ার খেলে এবং ফেসবুকিং করে।
এই বাজারে মোটামুটি কয়েক সপ্তাহ হলো বৃদ্ধলোকটি এসেছে। সাত-আট রাতের নিদ্রাহীন মুহূর্তগুলো কেটেছে নজরুলের দোকানের বারান্দায়। বাকি রাতগুলোর নিদ্রাহীন মুহূর্তগুলো কেটেছে বণিক সমিতির বারান্দায়। আজকে সন্ধ্যার পর থেকেই বাজারের ট্্রলার ঘাট সংলগ্ন এই জায়গায় বৃদ্ধলোকটি শুয়ে আছে। গাঙের শীতল পানির ছবি, উদাস বাতাস তাকে বিমোহিত করছে। এখন থেকে সে এখানেই থাকবে।
এশার নামাজের পর ফেসবুকিং প্রিয় ছেলেরা যখন এসে দেখে তাদের বসার স্থানটি বিনা পয়সায় দখল করে ঘুমাচ্ছে এক অপরিচিত পাগল তখন তারা আর বিরক্ত না করে কয়েকজন ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে, কয়েকজন বণিক সমিতির বারান্দায় এবং বাকিরা যে যার মতো করে নতুন সব জায়গা খুঁজে নিয়ে তাদের ফেসবুকিং চালিয়ে যায়।
বাজারের ডাস্টবিনই হচ্ছে পাগলের খাবার সংগ্রহ করার প্রধান উৎস। ডাস্টবিন থেকেই পচা-বাসি ভাত, সিঙাড়া-বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে লোকটিকে থাকতে হয়; তাই সুষমখাদ্যের অভাবে শরীর ভেঙে পড়ছে।
একদিন কোথা থেকে একটা পুরাতন থালা নিয়ে এসে ভিক্ষা করতে বসে পড়লো রাস্তার মোড়ে। পরদিন সকালে বাজারের দোকানিদের চোখে পড়লো তাদের দেওয়া নাম পাগলটি মারা গিয়েছে যার পাশে পড়ে রয়েছে ভিক্ষা করার থালাটি। এবার দোকানিরা দয়াবান হলেন। বণিক সমিতির নেতা এসে মাইকের ব্যবস্থা করে দিলো। মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, অপরিচিত পাগলের দাফনের জন্য সবাই আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্তহস্তে দান করুন’। মাইকের ঘোষণা শুনে সবার মনে তখন দয়া উঁকি দিতে লাগলো। আর ভিক্ষার থালাটি ভরে উঠলো টাকা-পয়সায়। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় কয়েক হাজার টাকা জমা হলো ভিক্ষার থালায়। ভিক্ষার থালা উপচে পড়ে চারপাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে টাকা গুলো গাদাগাদি করে পড়ে আছে। এই এতগুলো টাকার এখন আর প্রয়োজন নেই লোকটির। মৃত্যুর আগে ছিল।