খন রঞ্জন রায় »
জলকে দেখে আতঙ্ক হয় বলেই এই রোগের নাম জলাতঙ্ক। গ্রিক পুরাণে চার হাজার বছর আগেও জলাতঙ্ক রোগ বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। মৃত্যু অবধারিত এই রোগে আক্রান্ত হলে নানা উপসগর্, লক্ষণ দেখা দেয়। জলভীতি প্রধান উপসর্গ।
এছাড়া জ্বর, ক্ষুধামান্দ্য, ব্যথাসহ শব্দ ও ঠা-া বাতাস সহ্য করতে না পারা, কোন প্রকার তরল পদার্থ গিলতে না পারার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। প্রকট হয়। পানি পানের চেষ্টা করলে গলনালী ও তৎসংলগ্ন শরীরবৃত্তিয় অঙ্গপ্রতঙ্গে তীব্র সংকোচন হয়। ফল হয় প্রচ- ব্যথা। চূড়ান্ত পরিণত হয় হাইড্রোফোরিয়া বা পানিভীতি। পানিশূন্যতার ফলশ্রুতিতে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়ানোর অক্ষমতা সৃষ্টি হয়। চেতনাশূন্যতা দেখা দেয়, পাগলামো শুরু হয়, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ডিলিউসন, হ্যালুসিনেশন বলে অভিহিত করা হয়।
র্যাবিস নামক এক ধরণের নিউরোট্রপিক ভাইরাসের কারণে এই রোগ সৃষ্টি হয়।
সাধারণত এই ভাইরাসটি গৃহপালিত পোষাপ্রাণী ও কিছু ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণীদের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। সংক্রমিত ও আক্রান্ত এই প্রাণীসমূহের দ্বারাই মানুষের মধ্যে ছড়ায়। প্রাণীসমূহে উপরোক্ত উপসর্গের ফলে মানুষকে কামড়ায়, আচঁড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে, কখনোবা লালা নিঃস্মরণের সংস্পর্শে আসে। আর তখনই তা ছড়িয়ে পড়ে।
এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হলে কোন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। উপসর্গভিত্তিক কোন ওষুধই এই ভাইরাসের শক্তিমত্তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। ফল হয় আনিবার্য মৃত্যু।
সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ষাট হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বয়স হয় ৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। কেবলমাত্র কুকুরের কামড়েই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় ৯৫ শতাংশ মানুষ। বাকী ৫ শতাংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাঁদর, ইঁদুর, বিড়াল, শিয়ালসহ অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ-কামড়। এই ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে ৯৫ শতাংশ কুকুরের মধ্যে ৯৯ শতাংশই কিন্তু পালিত কুকুর দ্বারা আক্রান্তের ফলে মনিবের শেষ পরিণতি হয় মৃত্যু। মানুষও যদি সংক্রামিত হয়ে পড়ে তবে তার পাগলামো আচরণের কারণে কামড়, আঁচড় ও লালার মাধ্যমে অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। দুর্ভাগ্য যে, ট্রপিক্যাল এই র্যাবিস ভাইরাসটির আক্রমণের শিকার হয় দুর্গম পাহাড়ী, হাওর, বাওর, প্রান্তিক, অবহেলিত, অসচ্ছল, গরীব-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস এলাকা।
অ্যান্টারকটিকা ছাড়া পৃথিবীর সবদেশে জলাতঙ্কের মাধ্যমে মৃত্যুঝুঁকি আছে। তবে এই রোগাক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ৯৫ শতাংশ ঘটে এশিয়া ও আফ্রিকাতে। সচেতন হওয়ার কারণে উন্নতদেশসমূহ বিশেষ করে ইউরোপীয় এলাকা ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার আদর্শিক সহযোগিতায় ১৯৮৩ সাল থেকে সচেতনমূলক কার্যক্রম শুরু করে। তারা এ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক ও ৯৮ শতাংশ কুকুরের কামড় প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। জনসচেতনতার পাশাপাশি জলাতঙ্ক প্রতিরোধে আবিস্কৃত নানা ধরনের কার্যকর টিকা তারা ব্যবহার করছে। প্রতিরোধের জন্য তারা আগাম টিকা গ্রহণ করে। আর যদি কদাচিৎ পশুর কামড়ের শিকার হয় তবে তা প্রতিকারেও আবিস্কৃত ভিন্ন মাত্রা ও টিকা’র দ্রুত শরণাপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ প্রতিবছর জলাতঙ্ক প্রতিরোধে আগাম টিকা নিয়ে থাকে। আর একারণেই হাজার লক্ষ মানুষ ভয়াবহ নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকির ট্রপিক্যাল ভাইরাসের এই আতঙ্ক থেকে নিস্তার পাচ্ছে।
আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশও জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কুকুরের কামড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জনসাধারণকে আত্মরক্ষার কলা-কৌশল নিয়ে সচেতনামূলক কর্মসূচি চালানো শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যৌথভাবে প্রয়োজনীয় ও নির্ভরশীল এই কাজ শুরু করেছে ২০১০ সাল থেকে। আত্মরক্ষার কলাকৌশল শিক্ষার সাথে এই রোগ যেন না ছড়ায় এবং এই রোগ থেকে নিস্তার পেতে আবিস্কৃত সকল প্রকার ও ধরণের টিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিনামূল্যের এই টিকা যে কেউ সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে গ্রহণ করতে পারেন।
তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর ও জনগুরুত্বের নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করছে এই রোগ সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের বিশেষায়িত হাসপাতাল “বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিসেস (বিআইটিআইডি)”। যেটি চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশদ্বার ফৌজদারহাটে সমুদ্র উপকূল ঘেঁষা দৃষ্টিনন্দন নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট এই হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক হিসাবে উদ্যমী ভূমিকা পালন করছেন দেশসেরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আবুল হাসান চৌধুরী। উপÑপরিচালক হিসেবে প্রশাসনিক দীর্ঘ অভিজ্ঞ ডা. হোসেন রশীদ চৌধুরী মানসম্মত হাসপাতাল সেবা নিশ্চিতে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ তত্ত্বাবধান করছেন।
উক্ত হাসপাতালে জলাতঙ্কসহ ট্রপিক্যাল রোগসমূহের কার্যকর চিকিৎসা, চিকিৎসক, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নার্সসহ কর্মীদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ তদারকি, এই রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধে সর্বোচ্চ পেশাগত নৈতিকতা ও মানবিকতার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে এই প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের চিকিৎসক, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, নার্স ও সহায়ক কর্মীদের সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে মরণব্যাধি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান বাস্তবধর্মী এই অর্জন সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী বিধিবিধান প্রণয়ন, কর্মসম্পাদন ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে একযোগে বাস্তবায়ন কাজ করছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা বিশ্বের প্রায় সকল সংগঠন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব পশু স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বসংস্থাসমূহ যেমন গ্লোবাল অ্যালাইন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোল, ইউনাইটেড এগেইনেস্ট র্যাবিস, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশান (ইউএসএ) আমেরিকান হেলথ অরগনাইজেশন ইত্যাদি।
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব থেকে জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যুহার শূন্যে নামিয়ে আনার কৌশলপত্র নিয়ে জোরালোভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চলছে। জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানীদের নিরলস অধ্যবসায়ে নিয়ত-প্রতিনিয়ত আবিস্কার হচ্ছে নানা মান ও ধরণের প্রতিষেধক টিকা।
আগামী ১৫ বছরকে অতিসংবেদনশীল বছর হিসাবে (জরংশ) নিরুপণ করে মানসম্মত দক্ষসেবা প্রদানে সর্তক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। অব্যাহতভাবে আবিস্কৃত টিকাসমূহ থেকে আমাদের ট্রপিক্যাল জলবায়ু ও পরিবেশ উপযোগী কার্যকর ও নিরাপদ ‘হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিন’ (ঐউঈঠ) অধিক হারে সরবরাহ করা হচ্ছে। গেল বছর প্রায় ২ লাখ টিকা ও ৩ লাখ মানুষকে প্রাণীর কামড়ের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বিদেশনির্ভর টিকাসমূহের প্রাপ্তি জটিলতায় কোন কারণে সরকারি সরবরাহে বিলম্ব ঘটলেও বেসরকারিভাবে অতি অল্পদামে সদাসর্বদা নিশ্চিতভাবে তা পাওয়া যায়।
প্রান্তীয় অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মরণব্যাধি এই জলাতঙ্ক নিয়ে এখন সারা বিশ্ব সোচ্চার। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে ২০০৭ সাল থেকে এই দিবস বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে।
সচেতনতাই এই মৃত্যুরোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। আমাদেরকে আশেপাশের বেওয়ারিশ কুকুরসহ সকল পালিত পশু থেকে সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ ৪ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের বিষয়ে গুরুত্বসহকারে সাবধান হতে হবে। যদি কামড়, আচঁড়, লালা লেগেই যায় তবে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে টিকা দান নিশ্চিত করতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ-বৈদ্য থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। আর তা সম্ভব হলেই জলাতঙ্ক নামক আতঙ্ক থেকে আমাদের মুক্তির সনদ পাওয়া যাবে।
লেখক : টেকসই উন্নয়ন কর্মী