নূরনবী আহমেদ »
বিপ্রতীপ শব্দের অর্থ হচ্ছে বিপরীত। কারো জীবন যখন নিয়তি প্রদত্ত দুঃখের মাঝে আনন্দ খুঁজে পায় তা-ই বিপ্রতীপ জীবন।
জন্ম থেকেই মানিক প্রতিবন্ধী। ডান চোখ ট্যারা, বাম পা খাটো ও বাঁকা। লাভলীর স্বামী মুখভার করে থাকে, তার মায়ের মুখে শুধু অন্ধকার বসত করে। সময়ের আগমন ও প্রস্থানের মাঝে মানিক বড় হতে লাগলো। আরো সমস্যা চোখে পড়লো সবার। তোতলার মতো খুব কষ্ট করে কথা বলে সে।
মানিকের বাবা ঘরজামাই। প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গ করে, উপহাস করে। মানিক দুঃখ পায়; প্রকাশ করতে পারে না। মুখে ভালো করে কোনো কথা উচ্চারণও করতে পারে না। একটি শব্দ উচ্চারণ করতে মানিকের অনেক দেরি হয়। তাকে যখন কেউ ব্যঙ্গ করে, সে তখন কান্না করে কিন্তু কেউ ব্যঙ্গামি বন্ধ করে না। বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে মাথা রাখে। মা ললাটে চুমু দেয়। মায়ের চুমুর পরশে সকল দুঃখ বেঁচে থাকার আশ্রয়ে পরিণত হয়।
‘কান্দে না বাবা’
‘আ-আ-আ-ম-ম্ম’
অনেক কষ্টে মানিকের মুখ থেকে আম্মা শব্দটি উচ্চারিত হয়।
‘কে মাচ্চে?’
মানিক তার মায়ের ডান হাত, বাম হাত দিয়ে ধরে উঠোন থেকে সড়কের দিকে যায়। পিছন থেকে তার নানি ব্যঙ্গ করে, ‘লোলাঢা দিন-দিন বড় অইতাচে আর জালাইতাচে’।
বাম হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরে টেনে হাঁটছে আর কী যে কষ্ট হচ্ছে তা মানিক টের পাচ্ছে। তার মাও নাড়ি দিয়ে টের পাচ্ছে। কিছু পথ হেঁটে পশ্চিম দিকে হেঁটে যায়। মানিক আর হাঁটতে পারে না; মানিক দাঁড়িয়ে যায়।
‘বাবা কও কি অইচে’?
মানিক ডান হাত দিয়ে উত্তরের ক্ষেতগুলো দেখায়। সেখানে অনেক ছেলে খেলা করছে। তার মা ভাবছে হয়তো কেউ তার সাথে খেলা করছে না, তাই কাঁদছে।
‘বাবা কেলবা?’
মানিক মাথা নেড়ে না-সূচক জবাব দেয়। তার মা বুঝে হ্যাঁ।
‘আও বাবা’।
মায়ের ডান হাত ছেড়ে দিয়ে বাম হাত দিয়ে ইশারায় না করে। পুনরায় তার মায়ের ডান হাত চেপে ধরে। ডান হাত দিয়ে একবার ক্ষেতগুলোর দিকে দেখায় আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকায়। সাথে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে ও বন্ধ করে। মুখ দিয়ে বলতে পারে না ঐ ছেলেরা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে, কুটূক্তি করে।
অনেকক্ষণ তার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। তার মা আদৌ কোনো কিছ ুবুঝে না। শুধুমাত্র মানিককে এটা-সেটা অগোছানো প্রশ্ন করে। মানিক তার মায়ের ডান হাত ছেড়ে মাটিতে বসে পড়ে, মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। মানিক মাটিতে শুয়ে এলোপাতাড়িভাবে হাত-পা ছুড়ে কান্না শুরু করে। তার সারা শরীরে ধুলো লাগে। তার মা ওঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারপর অনুনয়-বিনয় করে।
‘ও আমার লক্কি আব্বা উডো, শইলো মাঢি বততাচে, শইলো অসুক অইবো’।
মানিক হাত-পা ছুড়েই যাচ্ছে; অন্য শব্দে কান্না করছে। তার মা একজনকে হাত উঁচিয়ে ডাক দেয়।
‘রশিদ ভাই দেক কিয়া যাও।’
রশিদ লাভলীর নিকটে আসলে ‘কি অইচে মাডিত হুতচে কেরে?’
‘দরো তো বারিত লইয়্যা যাই’।
রশিদ ও লাভলী মানিককে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
সকাল থেকেই বাড়ির সামনের পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে মাছধরার চেষ্টা করছে মানিক। মাছের কোনো হদিশ নেই। রাগে মাঝে-মাঝে ছিপ ফেলে দেয়। সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলছে তার বড়শির টোপে কোনো মাছ ঠোকর দেয়নি। মানিকের কাণ্ড দেখে তহুরা বিরক্ত হয়ে ওঠে। উঠোন থেকে পুকুরের পাড়ে লাভলীর কাছে এসে দাঁড়ায়। লাভলী মায়ের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মানিকের বড়শির দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তহুরার সাথে একটি কথাও বলেনি লাভলী।
তহুরা মানিকের দিকে চোখ রেখে লাভলীকে প্রশ্ন করে,
‘লোলা কয়ঢা মাচ মাচচে রে?’
‘আম্মা আমার চেরাডারে এবাবে ডাহো কেরে?’
তহুরা ঘরের ভিতরে চলে যায়, লাভলী মানিকের দিকে এগিয়ে যায়।
‘আববা উডো মাচ দরন লাগদো না, অনেক বেইল অইচে, কাওন লাগবো’।
মানিককে জোর করে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে হাত ধরে ঘরের দিকে এগিয়ে যায় লাভলী। বড়শিটি পুকুরের পাড়েই পড়ে থাকে।
বড়শিতে মাছ তো ধরলই না, বসে শুধু আনন্দ উপভোগ করা হলো। এই আনন্দ শুধু মানিকের। এতে কারো কোনো ভাগ নেই।
ঘরের ভিতর বসে থাকা মানিকের বিরক্তিকর ব্যাপার। বাইরের খোলা আকাশ তার মন টানে। বড়শি দিয়ে মাছধরা তার খুবই শখ। শুধু মাছ তার বড়শির টোপে ঠোকর দেয় না। মানিক তা ভেবে মাছের ওপর অভিমান করে। মুখ গম্ভীর করে ঘর থেকে বের হয়ে মাটির সড়কের দিকে আপনগতিতে হাঁটা শুরু করলো মানিক। সড়কের ওপর এসে মানিক কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলো। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে! দুপুর মাথার ওপরের আকাশে লেগে আছে। এ সময়ে কিবা করা যায়! একটি গাছের প্রতিচ্ছবির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
একজন লোক খোলা গায়ে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে আসছে। ডান কাঁধে একটি ছোট ভারবাঁশের ভার ঝুলছে; যার দুটি প্রান্তভাগে দুটি খাঁচা। পিছনের খাঁচায় তিনটি টিয়াপাখি, সামনের খাঁচায় দুটি ময়নাপাখি। লোকটির কোমরে গামছা বাঁধা। শার্টটি বাম কাঁধের ওপর। মানিক অবিরত পলকহীন দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে-দেখতে একেবারে তার চোখের সামনে এসে যায় লোকটি। মানিক যে গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকটিও সে গাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ায়। লোকটি কাঁধ থেকে ভারবাঁশ নামিয়ে মাটিতে রাখে। পকেট থেকে একটি বিড়ি ও গ্যাসম্যাচ বের করে বিড়িতে আগুন দিয়ে টানতে থাকে; লোকটির নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। কোনো কথাবার্তা না বলে লোকটি অবিরত বিড়ি টানে। মানিক পিছনের খাঁচার দিকে পলকহীন নজরে তাকিয়ে থাকে। টিয়াপাখি দেখেই তার মনে, মগজে ও মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বিড়ি টানা শেষ হলে লোকটি পুনরায় ভারবাঁশ মাটি থেকে তুলে ডান কাঁধে নিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটা শুরু করে। মানিকও লোকটির পিছু নেয় হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে। সামনের রাস্তার মোড় বেঁকে একটি পশ্চিম দিকে, আরেকটি পুবদিকে গিয়েছে। পাখিওয়ালা মোড় থেকে পশ্চিম দিকের রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। লোকটি মানিকের দৃষ্টিসীমার প্রায় শেষবিন্দুতে চলে যায়। মানিক মোড় থেকে পশ্চিম দিকের রাস্তায় হাঁটা শুরু করে।
পাখিওয়ালা মাঝে-মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে ফেলে আসা পথের দিকে তাকায়। তারপর চ-স্টলে বসে চা-বিস্কিট খায়। চা-স্টল থেকে বের হতেই দেখা যায় লোলা ছেলেটাকে। দেখেই সে হতভম্ব হয়ে যায়। এই ছেলে কীভাবে পিছু-পিছু চলে এসছে তার? বাতাসে উড়ে না খাঁচার ভেতর অদৃশ্য টিয়া-ময়নাপাখি হয়ে?
ছোট্ট ভাসমান খুপড়ি দোকান, যেটির সামনে কেডিএস গার্মন্টেস। বাম পাশে রাঙামাটি বাসস্ট্যান্ড। দোকানের সামনে দুটি পাখির খাঁচা। একটা লুলা ছেলে আনন্দে খাঁচার পাখিদের সাথে হি-হি হাহা-তা-তা করে আর সামনের থালাটি এক টাকা, দু’টাকার পয়সার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। পিছন থেকে একজন লোক আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনে-মনে আরো টাকা পাওয়ার তৃষ্ণা বেড়ে যায়। লুলা ছেলেটিও পাখিদের দেখে-দেখে আরো আনন্দে মেতে ওঠে। মানিককে পাওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে গ্রামের কারো তেমন ভাবার বা চিন্তার কারণ নেই। মানিক তো গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু না, তাই। লাভলীর মা তহুরা তো চমৎকার আনন্দ লাভ করে। সকালে ওঠে লোলা মানুষ দেখা মানেই সারাদিন অমঙ্গল আর রাতে লোলার অস্পষ্ট কথা শুনে ঘুমাতে যাওয়া মানে সারারাত ফেরেশতাদের অভিশাপ লাভ করা। সাথে গুনাগার হওয়া। কারণ মা-বাবা পাপী হলেই কেবল লোলা, বেওঙ্গরা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এটা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরাই বলে আর তহুরার কাছে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের কথাই সত্য।প্রতিবন্ধী সন্তান মানিক হারিয়ে গিয়েছে তাই তার বাবার মনে শান্তি নেই। মানিককে দেখার তৃষ্ণা তার বাড়ছে। যা হোক এই সন্তানের পিতা তো বাচ্চু। বিপ্রতীপ আনন্দ বাচ্চুকে ধীরে-ধীরে আঁকড়ে ধরলো। আর মানিকের মা লাভলী বিপ্রতীপ আনন্দে তীব্রভাবে ছটফট করতে লাগলো। যা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও অধিক।