বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে, ঋণ দিতে অনিচ্ছুক ব্যাংকগুলো

সুপ্রভাত ডেস্ক »
বিনিয়োগের আস্থার অভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণদান কার্যক্রম চাপের মুখে পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে গত দুবছর ধরে স্থবির ছিল বিনিয়োগ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।
২০২২ সাল থেকে ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগের প্রবাহ মন্থর রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নতুন কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব পাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের চাহিদাও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা ‘অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ’ নীতি অনুসরণ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। খবর টিবিএস’র।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা মূলত বিদ্যমান ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য কার্যকরী মূলধন প্রদান করছি।’
তিনি আরও জানান, নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব তেমন আসছে না। ২০২২ সালে ডলার সংকট শুরুর পর থেকেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ধীরগতিতে চলছে, আর জুলাই থেকে এটি আরও খারাপ হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট; এলসি) খোলার হারও ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, যা বিনিয়োগের স্থবিরতা প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ প্রায় ১৩% কমেছে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ৪৪% হ্রাস পেয়েছে। এটি ব্যবসার সম্প্রসারণে স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়।
‘আমাদের মনে হয় না ডিসেম্বরের আগে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিনিয়োগকারীরা এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে,’ মাহবুবুর রহমান বলেন। ডিসেম্বরের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না কেন তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সরকার এখনো বাজেটের আকার সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। পাশাপাশি, মেগা প্রকল্পগুলো কমিয়ে আনা হচ্ছে, যা বিনিয়োগের একটি প্রধান উৎস। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে, এবং বর্তমান অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। তাই সরকারকে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি এড়াতে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী, যার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি জুলাই মাসের ১০.১৩% থেকে আগের বছরের আগস্টের তুলনায় এ আগস্টে কমে ৯.৮৬%-এ নেমে এসেছে।
ভালো করছে কেবল ৫-৬টি ব্যাংক
বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিম্নমুখী।’
তিনি আরও জানান, বর্তমানে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি ব্যাংক ভালো করছে, যেখানে ৪০ থেকে ৪৫টি ব্যাংক খুব খারাপ পারফর্ম করছে। এ কয়েকটি ব্যাংক বাদে পুরো ব্যাংকিং খাতে ঋণ কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে আছে। তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহার ভোক্তা চাহিদা হ্রাসের প্রধান কারণ। ‘ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে, বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্পের কথা বিবেচনা করছেন না। অন্যদিকে, নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগও দেখা যাচ্ছে না, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক।’
হোসেন আরও বলেন, পোশাক খাত সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যদিও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। এ ছাড়া গ্যাসের ঘাটতি এবং অনিশ্চিত জ্বালানি পরিস্থিতিও উদ্বেগের কারণ।
তিনি জানান, অনেক ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষক ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যার ফলে সার্বিক পরিস্থিতি স্থবির অবস্থায় রয়েছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নীতিমালার কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে এবং বাণিজ্য ঘাটতি সংকুচিত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সরকারের প্রতি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিয়মিতভাবে বেসরকারি খাতের অংশীদারদের সঙ্গে [সরকারের] পরামর্শ করা উচিত। যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ বলেন, চলমান অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা উভয়েই নতুন বিনিয়োগে হাত দিতে দ্বিধাগ্রস্ত।
‘এ মুহূর্তে কোন খাতে বিনিয়োগ করা নিরাপদ, তা আমরা নিশ্চিত নই। কারণ যে কোনো সময় নতুন নীতিমালা আসতে পারে,’ বলেন আহমেদ। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো নতুন ব্যবসায়িক প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে দূরে থাকছে। বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ঋণের হার প্রায় ১৫% বেড়েছে, যা ব্যবসার জন্য কার্যকর নয়। ‘যদি কোনো ব্যবসা ১৫% হারে ঋণ নেয়, তবে সেটির ব্যয়-রেভিনিউ সমান হতে হলে কমপক্ষে ২০% রিটার্ন পেতে হবে, যা খুব কঠিন।’
তিনি উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভের হার ১০%-এর নিচে থাকে, ফলে ১৫% ঋণের হার কোনোভাবেই টেকসই নয়।
নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন ব্যবসায়ীরা
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা খুবই নিরাপত্তাহীন বোধ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত উদ্বেগে আছেন- আগামীকাল কী ঘটবে এবং তারা কী ধরনের ফোন কল পাবেন। শ্রমিক অসন্তোষ শুধু আশুলিয়া ও গাজীপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; আরও নানা সমস্যা ছিল। বাংলাদেশে ব্যবসা করা নিরাপদ তা নিশ্চিত করতে এখনই সরকারকে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে হবে।’
কম এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়নের হারও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, কারণ সরকারি প্রকল্পের ধীরগতি ঠিকাদারদের ব্যাংক থেকে অর্থায়ন চাইতে নিরুৎসাহিত করছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস, জুলাই-আগস্ট সময়কালে, এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল অত্যন্ত কম – ৩%-এরও নিচে।
২ অক্টোবর প্রকাশিত ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিপার্টমেন্টের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, এ সময় এডিপির খরচ ছিল সাত হাজার ১৪৩ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হারের দিক থেকে যা মাত্র ২.৫৭%।
আইএমইডি-এর ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো আর্থিক বছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৩%-এর নিচে ছিল না। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এ হার ছিল ৩.৮৪%, যা তার আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা কম।