সালাহ উদ্দিন সায়েম »
হেফাজতে ইসলামের আমীর ১০৩ বছর বয়সী মাওলানা শাহ আহমদ শফি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে না পারায় হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মদ্রাসার পরিচালক পদ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি পক্ষ চায় হেফাজতের মহাসচিব ও এ মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরীকে পরিচালক পদে বসাতে। কিন্তু আহমদ শফি না চাইলে এ পদে কেউ দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তবে তিনি বাবুনগরীর ওপর চরম ক্ষুব্ধ। তিনি মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমীকে পরিচালক পদে বসাতে চান। মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
আহমদ শফি ১৫ দিন হাসপাতালে অসুস্থ থাকার পর গত ২৬ এপ্রিল মাদ্রাসার বাসভবনে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি বাসায় আসার পর আগের মতো আর স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছেন না বলে সুপ্রভাতকে জানিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শফিউল আলম। তিনি জানান, আহমদ শফিকে রাইস টিউব (নাকে নল) দিয়ে শুধু তরল খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। তিনি ভালোভাবে কথাবার্তা বলতে পারেন না, হাঁটাচলাও করতে পারেন না। বাসা থেকে বের হন না।
এর আগেও কয়েক দফা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আহমদ শফি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং হজমজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
মাদ্রাসার পরিচালক পদ নিয়ে টানাটানি
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার পরিচালক পদে আছেন আহমদ শফি। এর আগে তিনি কয়েক দফা অসুস্থ হয়ে পড়লেও তখন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি সেটি না পাড়ায় পরিচালক পদ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের দুটি পক্ষের মধ্যে টানাটানি শুরু হয়েছে।
শনিবার হাটহাজারী মাদ্রাসার মসজিদে জোহরের নামাজ শেষে হেফাজতের কয়েকজন নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বসে। তখন মসজিদে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। এ ঘোষণার পর মাদ্রাসায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আহমদ শফি ও জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের দুটি পক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান নেয়। পরে রাতে দারুল উলূম মাদ্রাসার ফেসবুক পেইজে এক ভিডিও বার্তায় আহমদ শফি বলেন, ‘মাদরাসার জিম্মাদারি আমি কাউকে দিই নাই। জিম্মাদার কে হবে সেটা মজলিসে শূরা ঠিক করবে। আমি কাউকে মুহতামিম (পরিচালক) বানাইনি, কাউকে নায়েবে মুহতামিম বানাইনি। যেগুলো শুনছেন সেগুলো গুজব।’
মাদ্রাসার পরিচালক পদে নিয়োগের নিয়ম
হাটহাজারী দারুল উলূম মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী কমিটি ‘মজলিসে শূরা’র বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয় পরিচালক। আহমদ শফির আগে এ মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন মাওলানা হামেদ।
মজলিশে শূরার সদস্য হলো ২১ জন। শূরার সভাপতি হলেন আহমদ শফি। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আহমদ শফি অসুস্থ হয়ে পড়লে মজলিশে শূরার বৈঠকে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার দিকটি বিবেচনায় এনে তাঁকে দৈনন্দিন কাজে সহযোগিতা করার জন্য সহযোগী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় জুনায়েদ বাবুনগরীকে।
বাবুনগরীকে কেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে?
গত শুক্রবার হাটহাজারী মাদ্রাসা মসজিদে জুমার খুৎবার বয়ান নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের সূত্রপাত হয়। জুমার বয়ান করার কথা ছিল জুনায়েদ বাবুনগরীর। কিন্তু আহমদ শফি তাঁকে বাদ দিয়ে মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমীকে জুমার বয়ানের অনুমতি দেন। এর আগের জুমায় আহমদ শফির অনুপস্থিতিতে বাবুনগরী বয়ান করেছিলেন। মসজিদের নিয়মিত ইমাম বাড়িতে থাকার কারণে আহমদ শফির নির্দেশে মাদ্রাসার আলেমরা জুমার বয়ান করে আসছেন।
জুমার বয়ান থেকে বাবুনগরীকে বাদ দেওয়ার পর মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে গুঞ্জন রটে যায় আহমদ শফি দিদার কাসেমীকেই পরিচালক পদে বসাবেন।
বাবুনগরীর সাথে কেন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আহমদ শফির?
হেফাজতে ইসলামের কমিটি গঠনের পর থেকে আহমদ শফি ও বাবুনগরীর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর তাঁদের সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দেয়। হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন সভায় আহমদ শফি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে থাকলে তাতে মনোক্ষুন্ন হন বাবুনগরী। কিন্তু বাবুনগরীর হেফাজতের বিভিন্ন সভায় সরকারের নানা সমালোচনা করতে থাকেন।
গত বছরের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার দেয়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার মাস্টার্স ডিগ্রির সমমর্যাদা ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তাঁকে রাজধানীতে সংবর্ধনা দেন আহমদ শফি। এরপর থেকে আহমদ শফির সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরে বাবুনগরীর।
গত ৬ এপ্রিল দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ধর্ম মন্ত্রণালয় মসজিদে নামাজে সাধারণ মুসরিøদের জন্য বিধিনিষেধ জারি করলে তাতে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন আহমদ শফি।
কিন্তু দুই দিন পর মসজিদে বিধিনিষেদের বিরোধিতা করে পাল্টা বিবৃতি দেন হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
বাবুনগরীর ওপর চরম ক্ষুব্ধ আহমদ শফি
জুনায়েদ বাবুনগরীর ওপর হেফাজতের আমীর আহমদ শফি চরম ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষকরা।
মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দেস মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমী বিষয়টি স্বীকার করে সুপ্রভাতকে বলেন, জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলাতে হুজুর (আহমদ শফি) উনার ওপর প্রচ- ক্ষুব্ধ। উনার এমন আচরণ হুজুর এটা মোটেও পছন্দ করেন না।
হেফাজতে ইসলামের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রভাতকে বলেন, জুনায়েদ বাবুনগরী গত ফেব্রুয়ারি মাসে ফটিকছড়িতে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীর সাথে গোপন বৈঠক করেছেন। হুজুর (আহমদ শফি) বিষয়টা জেনে বাবুনগরীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
কে হবেন হাটহাজারী মাদ্রাসার পরবর্তী পরিচালক?
আহমদ শফি মজলিশে শূরার বৈঠকে পরিচালক নির্ধারণের কথা বললেও তিনি বাবুনগরীকে এই পদে কোনো অবস্থাতে বসাতে রাজি নয় বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক। তারা বলছেন, আহমদ শফি হয়তো এ মুহূর্তে বিশৃঙ্খলা এড়াতে কাউকে পরিচালক পদে দায়িত্ব দেবেন না। তবে তাঁর পছন্দের তালিকায় রয়েছেন মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমী। কাসেমীর পিতা মাওলানা আবদুল ওয়াহাব ৪০ বছর এ মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। আহমদ শফি ছিলেন তাঁর ছাত্র।
মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমী সুপ্রভাতকে বলেন, হুজুর (আহমদ শফি) আমাকে খুব পছন্দ করেন। তবে পরিচালক কে হবেন তা তিনি মজলিশে শূরার বৈঠক নির্ধারণ করবেন।
মাদ্রাসার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রভাতকে বলেন, হুজুর (আহমদ শফি) যেহেতু শূরা কমিটির সভাপতি, তাই তিনি যাকে পছন্দ করবেন তাতে অন্যরা সম্মতি দেবেন।
গত শনিবার হাটহাজারী মাদ্রাসা মসজিদে জোহরের নামাজের পর বাবুনগরীকে পরিচালক পদে ঘোষণা দেওয়া হেফাজতে কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মীর ইদ্রিস সুপ্রভাতকে বলেন, নিয়মানুযায়ী পরিচালক হবেন জুনায়েদ বাবুনগরী। প্রয়োজনে মজলিশে শূরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু এরআগে হুজুর (আহমদ শফি) অন্য কাউকে এ পদে বসানোর পায়তারা করছেন। যদি তিনি এটা করার চেষ্টা করেন তাহলে পরিস্থিতি ভালো হবে না।