বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া

স্নেহাশিস বড়ুয়া »

১৭ই আগষ্ট ২০২৩ এদেশের বৌদ্ধ তথা আপামর জন মানবের জন্য বেদনার হরফে লেখা শোকের চাদরে নিমজ্জিত হওয়ার এক দিন। এদিন সমাজ গগনের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া পরিবার, জাতিকে শোকের মহাসাগরে নিমজ্জিত করে অনন্ত ধামে গমন করেন। ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার মহাপ্রয়ানের আজ ঠিক ২ বছর হয়েছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, মলিন হয়েছে। কিন্তু ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া দেশ,জাতি, সমাজে অমর কীর্তি রচনার কারণে আজো জন মানবের হৃদয়ে চির অমলিন, চির অক্ষয়,চির অমর হয়ে আছেন।
প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ১৯৪৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার আবুরখীলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শিক্ষক ও সমাজনেতা কৈলাশ চন্দ্র বড়ুয়া, মাতা উপাসিকা মল্লিকা রাণী বড়ুয়া। শিশুকালে পিতা মাতা ঘরের নাম বা ডাক নাম দেন বটু। সে বটু থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ড. বিকিরণ হওয়ার পিছনে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া নামেই যার পরিচয়। নানা গুণে গুণান্বিত, নানা প্রতিভায় প্রতিভাদীপ্ত এ ক্ষণজন্মা ব্যাক্তিত্বের কর্ম কৃতিত্বের কথা সেতো বিশাল ইতিহাস। সে ইতিহাসের হরফে হরফে, পাতায় পাতায় আমরা পাই জাতিকে উজ্জীবিত করার দিক নির্দেশনা, সমাজ গঠনের আলোকিত মূলমন্ত্র, শিক্ষাকে বিকশিত করার উদ্দীপনা আর প্রাণশক্তি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উনার পদচারণা আমাদের চেতনাকে আরো প্লাবিত করে, শাণিত করে। সমাজসেবা,শিক্ষকতা,বিজ্ঞান চর্চা, লেখনি যেখানেই গেছেন সেখানে তিনি সফলতার সোনালী স্বাক্ষর রেখেছেন। বহুমাত্রিকতায় ভরপুর ড. বড়ুয়া ছিলেন একাধারে সমাজসেবক, সদ্ধর্ম প্রচারক, শান্তিদূত, বিশ্ব পরিব্রাজক, মানবতাবাদী, গবেষক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, অনুবাদক,বহু গ্রন্থ প্রণেতা, সুবক্তা, সুলেখক।
ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৭ সালে কক্সবাজার কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করে। পরের বছর যোগদান করেন রাঙ্গুনীয়া কলেজে। ১৯৬৯ সালে বরিশাল বি এম কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ, ১৯৮০সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ও ১৯৮২ সালে পুনরায় চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করেন। অতঃপর ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করে ২০১০ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনা করে তিনি অবসরে যান। সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করার সময়
ড. বড়ুয়া ১৯৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। উল্লেখ্য বড়ুয়া বৌদ্ধদের মধ্যে বিজ্ঞানে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী ধারী।
সমাজসেবা জগতের এ মহান আইকনের সমাজসেবার কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে আসে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের নাম। এ সংগঠনের বিস্তৃতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে ড. বড়ুয়া ব্যাপক অবদান রেখেছেন। যুব শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পথ চলা শুরু করে আমৃত্যু প্রচার সংঘের মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রচার সংঘকে করেছেন সমৃদ্ধ, সমাজকে করেছেন আলোকিত। বিশ্ব নন্দিত সংঘ মনীষা বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর আদর্শকে হৃদয়স্থ করে বৌদ্ধদের কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্যের বিকাশে অনন্য অবদান রেখে প্রচার সংঘের প্ল্যাটফর্মকে বেগবান করেছেন। প্রচার সংঘের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মন্ডলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পিছনে উনার অবদানকে সমাজ কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে। এছাড়া উনার সাংগঠনিক কর্মকুশলতার অনবদ্য সংযোজন বুদ্ধজ্যোতি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বখ্যাত সাংঘিক ব্যাক্তিত্ব বোধিসত্ত্ব হিসেবে খ্যাত মাষ্টার শিন উইন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠা করে তিনি অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আবুরখীল জনকল্যাণ সমিতি উনার সাংগঠনিক কীর্তির আরেক নাম। এ সংগঠনকে ডঋই -এর অনুমোদিত সংগঠন করে নিজের শেখর, নিজ গ্রামকে বহির্বিশ্বে পরিচিতি ও সমৃদ্ধায়ন করেন। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রাম তথা দেশে বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় বহুবিধ সংগঠনের জনক, কর্ণধার ড. বড়ুয়ার মাত্র কয়েকটির উপর রেখাপাত করা হলো। অর্ধশতাধিক সংগঠনের সাথে উনার গুরুত্বপূর্ণ সম্পৃক্ততা ড. বড়ুয়ার অসামান্য সাংগঠনিক দূরদর্শীতা, আন্তর্জাতিক পরিচিতি, সুনাম, সুখ্যাতির সমন্বিত ফসল।
দ্বিতীয়তঃ শিক্ষক হিসেবে ও তিনি বেশ সফল ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। উনার হাজার হাজার ছাত্র -ছাত্রী দেশ বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। উনার অনেক ছাত্র -ছাত্রী সরকারী, বেসরকারী উচ্চ পদে থেকে, দেশ বিদেশে সফল ব্যবসায়ী হয়ে দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এদেশের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করে চলেছেন। তিনি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার আলো বিতরণ করেছেন তন্মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নাম অগ্রগণ্য। একজন আদর্শ শিক্ষকের রোল মডেল হলেন ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া। অনেকেরই প্রিয় ও আদর্শ শিক্ষক এ বিকিরণ বাবু শিক্ষা বিস্তারে বিশেষত বিজ্ঞান শিক্ষা বিস্তারে অনন্য অবদান রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসরের আগ পর্যন্ত উনার অবিস্মরণীয় মেধা, কর্মদক্ষতার ফলে পদার্থবিদ্যা বিভাগকে এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছিলেন। উনার সমকালে বাংলাদেশের পদার্থবিদ্যা বিভাগের মধ্যে যেসব অধ্যাপক খ্যাতির শীর্ষে উপনীত ছিলেন তন্মধ্যে ড. বিকিরণ বড়ুয়ার নাম অগ্রণী কাতারে থাকবে। তৃতীয়তঃ লেখক হিসেবে ও তিনি যথেষ্ট মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নানা পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাময়িকী, দেশি-বিদেশি জার্নালে উনার প্রচুর লেখা ছাপানো হয়েছে। বিভিন্ন পত্র -পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাময়িকীতে উনার লেখা সমাজকে সমৃদ্ধ করেছে, পাঠককুলকে করেছে ঋদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বাংলাদেশ-এর প্রকাশিত বিভিন্ন পদার্থবিদ্যা জার্নালে উনার ১৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
বৌদ্ধ সমাজের আকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে, হিংস্র অপশক্তি যখন হামলে পড়ে সমাজের বুকে তখন ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়াকে সাহসিকতার সাথে ত্রাতার ভূমিকায় দেখা যেত। বিশেষ করে ২০০২সালে দেশ-বিদেশের আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাউজানের হিংগলায় জ্ঞানজ্যোতি ভিক্ষুকে কয়েকজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাজপথে সামনের কাতারে থেকে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ এবং হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া। তাছাড়া ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল ফিরোজ মান্না জনকণ্ঠ পত্রিকায় বুদ্ধ, বান্দরবানের বুদ্ধ ধাতু জাদী ও রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার সম্পর্কে চরম মিথ্যাচারে পুষ্ট, বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত হানীকর প্রতিবেদন প্রকাশের ড. বড়ুয়াকে অত্যন্ত সোচ্চার ও প্রতিবাদ মুখর হতে দেখা গেছে। মোট কথা সমাজের উপর যখনই অত্যাচারের বুলডোজার নেমে আসত, ঘোর অমানিশার কালো মেঘ যখনই সমাজ গগনে দেখা যেত তখনই ড. বিকিরণ বড়ুয়াকে সাহসী বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যেত। সমাজে অনৈক্য, বিভাজনের কালো দেওয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে মৈত্রীপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে সমাজে সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনা করার উনার নানা প্রয়াস আমরা দেখেছি। তাইতো শান্তি, সম্প্রীতি ও মহাঐক্যের প্রতিভূ বলা যায় এ খ্যাতিমান ব্যাক্তিত্বকে।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া। সমাজে অনবদ্য কীর্তিগাঁথা রচনার জন্য তিনি দেশ -বিদেশে নানা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, নানা অলংকরণে নিজেকে অলংকৃত করেছেন। ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া যেসব উপাধি,সম্মাননা, অলংকরণে ভূষিত হয়েছেন তন্মধ্যে একুশে পদক, হিউম্যান রাইট পিস এ্যাওয়ার্ড, শেরে বাংলা পদক, বিশ্ব বৌদ্ধ মহারত্ন, চসিক একুশে পদক, মাহাত্না গান্ধী এ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা মেমোরিয়াল এ্যাওয়ার্ড, দি আউট স্ট্যান্ডিং ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট লীডার এ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপংকর স্বর্ণপদক, আচার্য শিন উইন শান্তি পুরস্কার, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ পুরস্কার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজ কল্যান ফেডারেশন কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী উপাধি উল্লেখযোগ্য।
ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া আমাদের গর্ব, অহংকার, সমাজসেবা জগতের আইকন, জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, চেতনার বাতিঘর। ড. বড়ুয়া অনন্যতায় ভাস্বর বিশাল ব্যাক্তিত্ব। উনি উনার বিশাল কর্মময় জীবনের আলোক ছটায় দীপ্যমান করেছেন সমাজকে। এভাবে শত শত বিকিরণ যেন বাংলাদেশের বুকে আবির্ভূত হয়ে বাংলাদেশকে মহিমান্বিত করতে পারে এ প্রত্যাশার ফানুস উত্তোলন করছি। পরিশেষে এ মহান শিক্ষাবিদের কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন করে যে কোন পাবলিক ভার্সিটির ১টি হলের নাম ‘ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া হল’ এ নামে নামকরণের জন্য সদাশয় সরকারের কাছে সমাজের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক পরিচিতি : বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।