আরিফুল হাসান »
কবিরকে আমরা সবাই ঘৃণা করতাম। কী আছে কবিরের? না ঘর, না পিতৃপরিচয়। পড়ে থাকা মাঠের মতো, মরে যাওয়া মায়ের স্মৃতি ধরে সৎবাবার সাথে থাকে। সে কি থাকা? না থাকার মাঝেও নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা। এই নামমাত্র থাকাতেও কবিরের আনন্দ। অথবা বেদনার রং তার চোখেমুখে এমনভাবে লেপ্টে গেছে যে আমরা তার ভালো থাকা বা মন্দ থাকাটা আলাদাভাবে ধরতে পারতাম না। তবে এটুকু বুঝতাম কবির আমাদের মতো নয়। তখন ভয় হতো, আসলেই কি কবিরকে আমরা ঘৃণা করি, নাকি ভয় পাই? তখন মনে হতো ভয় পাই। সত্যিই ভয় পাই কবিরকে। আমাদের কৌতুহল বেড়ে যেতো। সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো কবিরের দেহে পীতাভ রং, মুখখানা সবসময়ের জন্য ভাবলেশহীন। আমরা এগিয়ে যেতাম কবিরের সাথে মিশতে। আবার পাশ ফিরে শোবার মতো মুখ ঘুরিয়ে নিতাম কবির থেকে। মনে হত দুঃস্বপ্ন দেখছি কোনো। কবিরের মুখ যখন দেখতাম, তখন নিঃসঙ্গ রাতের মতো একটা হাহাকার আমাদেরকে ছুঁয়ে যেতো। আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতাম। নিতাম অবশ্য কারণ আছে। আমাদের গার্জিয়ানরা খুব কড়া করে না-করে দিয়েছিল কবিরের সাথে মিশতে। কোথাকার কোন্ জন্মপরিচয়হীন সন্তান, মায়ের সাথে জুড়ে এসে বসেছে মকবলের কাঁধে। মা তো তার থাকেনি। দুবছর যেতে না-যেতেই মা-টা মরল। কাঁধে চেপে রইলো নাবালক কবির। মকবল দরিদ্র সংসার আর একাকিত্বের যাতনা সইতে না পেরে আবার বিয়ে করলো। সে ঘরেও সন্তানাদি হলো। শুধু সন্তান না হয়েও সে ঘরে বেড়ে উঠতে থাকলো কবির।
কবিরের বয়স বারো কি চৌদ্দ। তার এই সৎমায়ের সংসারে তিনজন ঝি। ছেলেপুলের আশায় মকবুল আবার রাত্রি হলে উপগত হয়। কিন্তু এবারও সন্তান আসে মেয়ে। মকবুলের মনকালো মেঘের মতো জমাট বাঁধতে থাকে। ক্ষোভ এসে পড়ে কবিরের ওপর। কথায়-কথায় হালের লাঠি দিয়ে, মাছধরা জালের বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি মারে তাকে। কবির কাঁদে না। বিতাড়িত কুকুরের মতো মুখ গুঁজে ঘরের এ কোনা থেকে সে কোনায় যায়। ঘাটায় গিয়ে বসে থাকে। বাড়ির দক্ষিণে বয়ে যাওয়া খালটির ঘোলা স্রোতে নিজেকে কল্পনা করে ঝিমোয়। তারপর হয়তো ওঠে যায় সুলতানদের তালপুকুর পাড়ে। সেখানে এখন সারি-সারি আমের গাছে মনকাড়া আম পেকে আপনা-আপনি পড়ছে গাছ থেকে। কিন্তু সুলতানদের বুড়ো খুড়িটা ওসব ধরতে দেয় না কাউকে। ভুতের মতো ফজরের আগ থেকে রাত জমে যাওয়া পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় আমগাছ থেকে আম গাছতলায়। তবু বুড়ির চোখ ফাঁকি দিয়ে দুয়েকটা আম পাওয়া যায়। বিশেষ করে উত্তরপাড়ের যে জঙ্গল, বেথুম ঝোপ, গাইট্টারা কাঁটার বিস্তার, বিষাক্ত কালো কচু, ছিপটিন ঝোপ, পুমা গাছের অসংখ্য বিস্তার, বনকলমির ঝোপ, একান্ত আবশ্যিকভাবে বাঁশঝাড়, কাঁটাঝোপ ও মুর্তারবন দিনের বেলাকেও যেখানে অন্ধকার করে রাখে, সেখানে টকছোবড়া আম কুড়াতে বুড়ি খুব কমই যায়। গ্রামের দুরন্ত ছেলেরা, অভাবী সংসারের ছেলেমেয়েরা সাপজোঁকের ভয় অগ্রাহ্য করে সেখানে আম কুড়াতে যায়। কখনো-কখনো বিষাক্ত সাপের মুখোমুখি হয়। তারা দুরুদুরু বুকে কাঁপতে-কাঁপতে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে। কখনো জোঁক আঠার মতো লেগে যায় পায়ে, রক্ত খেয়ে ঢোল হয়। ছেলেমেয়েরা এসব বিপদ অগ্রাহ্য করেই সেখানে যায়। কবিরও যায়। তার যখন মন খারাপ হয়, খুব বেশি কাঁদতে ইচ্ছে করে তখন সে সুলতানের পুকুর পাড়ের এই জঙ্গলটির ভেতর যায়। দুয়েকটা বুনোফল-টল হয়তো কুড়িয়ে পায়। হয়তো তার ইচ্ছে হয়, বিষাক্ত সাপটা তাকে কেটে ফেলুক। কিন্তু সে মরে না। এক দুপুর জঙ্গলে কাটিয়ে আবার সে ফিরে আসে।
বাড়িতে আসলে সৎমা হয়তো তাকে ভাত দেয় না। বাবাটার হয়তো মায়া লাগে। আপন না হোক মৃত বিবির গর্ভের ধন তো। তার কাছে তো আমানত। তখন সে হয়তো কবিরকে আড়ালে ডেকে দুটো পয়সা ধরিয়ে দেয়। কবির হবির মার দোকান থেকে একটা পাওন কিনে পেট নিস্তার করে। মুখ মুছে সে দুতিন মগ জল খায়। তারপর আবার কোথাও হারিয়ে যাবার আগে একবার সে খুশিমনে মকবলের সামনে যায়। হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়ায়। মকবল তখন হয়তো তার প্রতি আরেকটু মায়া বাড়ায়। হয়তো বলে, Ñখরোডাত যাইয়া বচ্চা। কয়ডা মাছ পাইলে অদো বিহালে বাজার নেওন যাইবো। কবির তখন পৌঢ়াখালটাকে ঘিরে রাখা খরো জালের ওপরে গিয়ে বসে। দূর থেকে দেখে আমাদের কাছে সিংহাসন মনে হয়। কবির পায়ের চাপে সরসর করে জাল তোলে। ঝুপঝুপ করে জাল থেকে পানি পড়ে। গাব দেয়া জালের বুকে পুঁটি, টেংরা লাফাতে থাকে। কবির জাল টেনে-টেনে সেগুলো ডুলায় ভরে। তারপর আবার বাঁশের খুটি ধরে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে আপনা-আপনি ওঠে যায় তার সিংহাসনে। তখন আবার জাল বিছিয়ে পড়ে পৌঢ়াখালটির বুক জুড়ে। বিকেলে হয়তো যা কিছু মাছ জমেছে তা নিয়ে মকবল বাজারে যায়। হয়তো তখন কবির ঘুরতে থাকে মকবলের পাছে। এমন সময় হয়তো মকবলের বড়মেয়ে আছিয়াও এসে আব্দার করে বাবার সাথে বাজারে যাওয়ার। কবির বুঝতে পারে, তার আর বাজারে যাওয়া হবে না। ভাবলেশহীন মুখে সে সেখান থেকে সরে পড়ে।
কবিরকে আবার দেখতে পেয়েছি দীর্ঘ সাতাশ বছর পর। তখন আমাদের জীবন থেকে কেটে গেছে অনেক বর্ষা। কেটে গেছে অনেক জ্যোৎস্নাবিধৌত রাত। অনেক অমাবস্যা শেষে কবিরকে আবার পেয়েছি। সেবার আমরা গ্রামে গেলে প্রথম যে লোকটির সাথে দেখা হয় তাকে চিনতে বেশ বেগ পেতে হয়নি। সেই একই ভাবলেশহীন চিরচেনা কবিরের মুখ। কবির আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। কী খবর? জিজ্ঞেস করে। আমিও কবিরকে কুশল জিজ্ঞেস করি।
কবির তেমনি ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দিয়ে চলে যায়। বিকেলে গ্রামের বাজারে হাঁটতে গেলে আবার কবিরের দেখা পাই। ডেকে চা খাইয়ে জিজ্ঞেস করি, কবির ভাই, এতদিন কি গ্রামেই আছেন? আরে না! কবির বলে। সে ছিলো ঢাকা শহরে। মিষ্টির দোকানে কাজ করে বোনদের বিয়ে-শাদি দিয়েছে। বাড়িতে নতুন ঘর তুলেছে। শুনলাম মকবল আর মকবলের স্ত্রী এখন তার ওপরই নির্ভরশীল। খালে ব্রিজ হয়েছে, পৌঢ়া বৃদ্ধ হতে-হতে মরে গেছে। সংসারের আয়- রোজগার বলতে এখন তার ইনকামই। বললাম, কবির ভাই, বিয়ে-শাদি করেছেন? জীবনে এই প্রথম তার মুখে একটা লাজুক হাসি ফুটে ওঠে। ডানে-বামে মাথা দোলায়। জানালো, পিতা তাকে সম্পত্তির ভাগ দিতে চাইলেও চাচাতো ভাইয়েরা কিছুতেই দিবে না। তাদের এক কথা রক্তের কুনু সম্পর্ক নাই। কবির হাসে, বুঝজেন রক্ত, রক্তই অইলো আসল। আমি বললাম, আপনি যে তাদেরকে করছেন এর কি কোনো প্রতিদান নেই? কবির একগাল হাসে, আমি তো কুনু বিনিময়ের জন্য করতাছি না ভাই। টাকা জমাইলে আমিও একটা বাড়ি করতাম পারতাম। কামাইর টাকায় বইনেরারে বিয়া দিছি। চাইর-চাইরজন বইন। এহন ওই বোনের জামাইরাও কয় আমি বলে কেউ না। কবিরের হাসির ফাঁকে কখন যে তার চোখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে টের পাই না। দেখি একটা ফোঁটা টলমল করছে কবিরের চোখে।
মুখ ফিরিয়ে কবিরকে একটু আড়াল দিলাম চোখের পানি মুছে ফেলার জন্য।