সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলাদেশে কক্সবাজারের অদূরে মাতারবাড়িতে বঙ্গোপসাগরের তীরে যে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলার কাজ চলছে, তা বাংলাদেশ, জাপান ও ভারতের মধ্যেকার পারস্পরিক অর্থনীতির সমীকরণকে অচিরেই বদলে দেবে বলে টোকিও মনে করছে। ভারতে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোশি সুজুকি ত্রিপুরার আগরতলায় এক হাই-প্রোফাইল আলোচনাচক্রে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
জাপানের অর্থায়নে নির্মীয়মান এই মাতারবাড়ি বন্দর ‘বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই একটি উইন-উইন সিচুয়েশন’ সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রদূত সুজুকি। ২০২৭ সালের মধ্যেই এই বন্দরটি চালু করা যাবে বলেও আশাবাদী তিনি। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
ভারত ও বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে প্রথম ডিপ সি পোর্ট (গভীর সমুদ্র বন্দর)। এই মাতারবাড়ি থেকে ভারতের ত্রিপুরার দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটারের (৬২ মাইল) মধ্যে। কাজেই এই বন্দরটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্যও একটি গেটওয়ের কাজ করবে।
পুরো প্রকল্পটির রূপায়নে জাপান সরকার খুবই উৎসাহ দেখাচ্ছে, কারণ তারা বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে একটি ‘বঙ্গোপসাগরীয় শিল্পহাব’ গড়ে তুলতে চায়। এই উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনায় মাতারবাড়ি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। ভারতে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ এমনটাও বলছেন, বাংলাদেশ-জাপান-ভারতের মধ্যে একটি ফ্রি ট্রেড জোন (অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল) গড়ে তোলারও পথ প্রশস্ত করবে এই প্রকল্প।
কী বিশেষত্ব আছে যাতে মাতারবাড়ি এরকম গুরুত্ব পাচ্ছে?
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএসের অধ্যাপক ও কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ প্রবীর দে-ও যোগ দিয়েছিলেন ত্রিপুরার ওই অলোচনাচক্রে। তিনি জানিয়েছেন, ‘মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্টে খুব বড় আকারের পণ্যবাহী জাহাজ, অর্থাৎ যেগুলো ৫০০ বা তারও বেশি কন্টেনার বহন করতে পারে, সেগুলোও কিন্তু অনায়াসে ভিড়তে পারবে।’
‘বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য বন্দরে যখন সিল্টেশন একটা বড় সমস্যা, ড্রেজিং ছাড়া বন্দরের নেভিগেশন চ্যানেলগুলো চালু রাখাই সমস্যা হয়ে উঠছে তখন কিন্তু সমীক্ষা বলছে মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্টে এটা কোনও সমস্যা হবে না। তাই বলা যেতে পারে এটা হবে প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর’ জানিয়েছেন প্রবীর দে।
এই বিপুল সম্ভাবনা আছে বলেই মাতারবাড়ি প্রকল্পে জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা বিপুল পরিমাণ অর্থলগ্নি করছে। শিনজো আবে যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই এক দশক আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকারের সঙ্গে তিনি এই প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন।
ত্রিপুরায় ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’ আয়োজিত আলোচনাসভায় জাপানের রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) জানান, তাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা যখন গত মাসে ভারত সফর করেছিলেন, তখনই তিনি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে (বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত) শিল্প হাব গড়ে তোলার ব্যাপারে নতুন করে প্রস্তাব দেন।
আর শুধু মুখের কথাই নয়, দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী কিশিদা মাতারবাড়িসহ বাংলাদেশের মোট তিনটি অবকাঠোমো প্রকল্পের জন্য ১২৭ কোটি ডলার আর্থিক বরাদ্দও অনুমোদন করেছেন। মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্ট প্রকল্প রূপায়নে তা অবশ্যই বাড়তি গতি সঞ্চার করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হানও আগরতলার ওই আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘এই পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ যে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, মাতারবাড়ি তার একটা অনবদ্য দৃষ্টান্ত। এই প্রকল্প থেকে শুধু বাংলাদেশই নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশও উপকৃত হতে পারবে।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্ককে সবাই ‘সোনালি অধ্যায়’ বলেই চেনেন। এখন মাতারবাড়ি পোর্ট জাপানকেও সেই সম্পর্কের মধ্যে নিয়ে এসে অর্থনীতির একটি চমৎকার ‘ত্রিভুজ’ তৈরি করতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা একমত।