নাসরীন মুস্তাফা »
বাঙালির একটি স্বাধীন দেশ হবে-বাঙালিকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নিজের ভেতর স্বপ্নের বীজ বোনা এক মানুষ, যিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির স্বার্থরক্ষার জন্য সব সময় সোচ্চার থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসে অমোচনীয় ছাপ রেখে প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দিতে বাঙালিকে স্বাধীনতাকামী জাতিতে পরিণত করেছেন, অত্যন্ত সুগভীর পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্ভব করে তুলেছেন।
২৫ মার্চের কালরাতে হায়েনার দল ঘুমন্ত বাঙালির উপর যখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গণহত্যার উন্মত্ততায়, তখন তিনি প্রস্তুতকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা যাতে সব বাঙালির কাছে পৌঁছে যায়, পরিকল্পনামাফিক সেই কাজ করে যান। একাজে তিনি বিশেষভাবে নির্ভর করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলেন, ‘…তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম, বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তখন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। বার্তা প্রচারের জন্য ট্রান্সমিটার দরকার ছিল। আর ছিল ওয়্যারলেস শিপিং চ্যানেল, যার মাধ্যমে সমুদ্রে জাহাজগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালির হাতে পৌঁছে দিতে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন ট্রান্সমিটার আর ওয়্যারলেস প্রযুক্তি।
বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্বাক্ষ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে পড়ে রেকর্ড করেছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর প্রকৌশলী নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা থেকে একটি ট্রান্সমিটার জোগাড় করেছিলেন। এই নির্দেশের কথা আর কারোর জানা ছিল না, নূরুল হক পরিবারের সদস্যদেরকেও জানাননি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ট্রান্সমিটারটি বসিয়ে দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগে আগে বঙ্গবন্ধুর টেপকৃত বার্তা এই ট্রান্সমিটার দিয়ে টেলিফোনে বিভিন্ন নেতা ও সূত্রের কাছে পাঠানোর কাজটি করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ কর্মী হাজী মোহাম্মদ মোর্শেদ। বঙ্গবন্ধুর সাথে গ্রেফতার করা হয় তাঁকেও।
চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসার ৮০৭৮৫ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে আসা টেলিফোন কলে ঐতিহাসিক বার্তাটি পেয়ে যান তাঁর স্ত্রী, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর। তিনি রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডর সলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কোস্টাল অপারেশনাল বিভাগের কর্মীদের কাছে বার্তাটি পৌঁছে দেন। আর রাতের মধ্যেই জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় আসা বার্তাটি ওই রাতেই হাজারি গলির বিনোদা ভবনে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে কর্মীদের কাছে পৌঁছানো হয়। পরে আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পাথরঘাটার বাসার সাইক্লোস্টাইল মেশিনেও বার্তাটি কপি করে বিলিয়ে দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ ভোরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি হাতে পেয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত বাঙালি কর্মীরা কেউ মাইকযোগে তা প্রচার করেন, কেউ আবার সাইক্লোস্টাইল করে ছড়িয়ে দেন।
সলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কোস্টাল অপারেশনাল বিভাগের টেলিফোন রেডিও টেকনিশিয়ান জালাল আহমেদ বার্তাটি লিখে নিয়েছিলেন। স্টেশনের কর্মীরা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সমুদ্রে অবস্থিত ইন্ডিয়ান জাহাজ ‘ভিভি গিরি’, অন্য বিদেশি জাহাজ ‘সালভিটা’, ইউনাইটেড নেশনের জাহাজ ‘মিনি লা-ট্রিয়া’সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি জাহাজ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে কলকাতা বেতারের উদ্দেশে ডুপ্লেক্স চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন, যা ২৬ মার্চ সকাল প্রায় ৭টা-৮টার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি বহির্বিশ্বেও। ২৭ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, ‘২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান দুটি বার্তা সম্প্রচার করেছেন। একটি অজ্ঞাত রেডিও স্টেশন থেকে বিশ্বের কাছে পাঠানো এক বার্তায় আওয়ামী লীগ নেতা (শেখ মুজিব) ঘোষণা দিয়েছেন যে ‘শত্রু’ আঘাত হেনেছে এবং জনগণ বীরের মতো লড়াই করছে। বার্তাটি কলকাতা থেকে শোনা হয়েছে। রেডিও স্টেশনটি নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছে। শিলং থেকে শোনা স্টেশনটির পরবর্তী সম্প্রচারে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছেন।
২৬ মার্চ দুপুর পৌনে ২টার সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে এই ঘোষণা আবার প্রচার করেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। ২৭ মার্চ ঘোষণটি পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান।
এবার বলছি ১৯৭১কে মনে করিয়ে দেওয়া ১৯৮৩ সালের কথা। সেসময় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ ছিল। আর সেসময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ‘প্রতীতি’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছিল, যেখানে চট্টগ্রাম কাস্টমস-এর জয়েন্ট কালেক্টর আবদুল কাইউমের ‘সেই কালো রাত’ শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা স্থান পেয়েছিল। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে মগবাজার ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ওয়্যারলেস স্টেশনের সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন আবদুল কাইউম, পরে তিনি কাস্টমস ক্যাডারে যোগদান করেন। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘সেই কালো রাত’, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকার, অন্যন্য গবেষক ও ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বয়ান থেকে জানা যায়, তিনি ২৬ মার্চ ভোরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লেখা একটি চিরকুট পান। প্রকৌশলী আবদুল কাইউম চিরকুটের লেখা পড়েই বুঝতে পারেন, এ-ই হচ্ছে বাঙালির সেই মহার্ঘ্য স্বাধীনতার ঘোষণা। তখন তিনি তাঁর সহকর্মী অপারেটর মেজবাহ উদ্দিনের সাহায্য নিয়ে ভিএইচএফ লিংক ব্যবহার করে বার্তাটি সারা দেশে এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত জাহাজের মাধ্যমে বিশ্বময় পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি প্রেরণের জন্য শহিদ হওয়া দুই বীর প্রকৌশলী নূরুল হক এবং ইপিআর সুবেদার মেজর শওকত আলীসহ বার্তাটি দেশে তো বটেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন যাঁরা, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ এ দেশের ছাত্র-জনতা প্রত্যেক বীর বাঙালিকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ও কৃতজ্ঞতা- পিআইডি ফিচার।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা।
(পিআইডি ফিচার)