আজহার মাহমুদ »
বাংলা সাহিত্য জগতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি শুধু একজন সাহিত্যিক ছিলেন না, বরং ছিলেন বাংলা গদ্যের পথিকৃৎ এবং উপন্যাসের জনক। তাঁর সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেম, সমাজচিত্র, মানবজীবনের রূপ-রস এবং কল্পনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর অবদান বাংলা গদ্য ও উপন্যাসকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর লেখনী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ২৬ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন ডেপুটি কালেক্টর। বঙ্কিমচন্দ্র হুগলি কলেজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় ব্যক্তি যিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সাহিত্যই ছিল তাঁর প্রকৃত আবেগের জায়গা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে বাংলা গদ্য তেমন সমৃদ্ধ ছিল না। যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ গদ্য রচনায় অবদান রেখেছিলেন, তবে বঙ্কিমচন্দ্র এই ধারাকে আরও সাবলীল ও গতিশীল করেন। তাঁর লেখনীতে সাহিত্যের উৎকর্ষ, অলঙ্কারিকতা ও গভীরতা ছিল। বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক চর্চা তখনো ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবমুক্ত ছিল না, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা গদ্যকে স্বাধীন রূপ দেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত বাংলা গদ্যগ্রন্থ ছিল ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪), যেখানে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন। তাঁর রচনায় ভাষার স্বচ্ছতা, গঠনশৈলী ও চিন্তার গভীরতা বাংলা গদ্যের সমৃদ্ধিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি সাহিত্যকর্মে খাঁটি বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটান, যা পরবর্তী কালে বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয়।
তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্য আজীবন মনে রাখবে উপন্যাসের জন্য। তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) রচনা করেন, যা বাংলা উপন্যাসের ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর উপন্যাসে সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম ও রোমান্সের এক অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস লেখার যে ভিত্তি তিনি স্থাপন করেন, তা আজও অনুকরণীয়।
তার কিছু কিছু অসাধারণ উপন্যাস রয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে। যারমধ্যে ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮৫), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪), ‘সীতারাম’ (১৮৮৬) উল্লেখযোগ্য।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য ভাবনা ছিল বহুমাত্রিক। তিনি কেবল রোমান্টিক বা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেননি, বরং তাঁর রচনায় সমাজের নানান অসঙ্গতি, বৈষম্য, নারীর অবস্থা, রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবাদী মনোভাব ফুটে উঠেছে। তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন। এই উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। বঙ্কিমচন্দ্র নারীর অবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন, সমাজে নারীর প্রতি অন্যায় কতটা গভীর হতে পারে। তাঁর রচনায় নারী চরিত্র শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা। কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, রাজিয়া প্রভৃতি চরিত্র তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একইসাথে তিনি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁর রচনায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। ‘সীতারাম’ উপন্যাসে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার চিত্র তুলে ধরেছেন। একারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যের সত্যিকার আধুনিক যুগের সূচনা বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার প্রভাব আজও অম্লান। তাঁর সাহিত্যকর্ম কেবল বিনোদনের উপকরণ নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তাঁর রচনায় বাংলা ভাষার শুদ্ধতা, চিন্তার গভীরতা এবং সাহিত্যিক উৎকর্ষতা এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে। তাঁর সাহিত্য আজও পাঠকদের অনুপ্রেরণা দেয়, জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং সমাজের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরে। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের জগতে তাঁর অবদান সত্যিই অসীম।