ফ্লাইওভারের সুবিধা সীমিত করবে র‌্যাম্প স্বল্পতা

রাজিব শর্মা »

যানজট নিরসনের লক্ষ্যে গত বছরের আগস্টে র‌্যাম্প ছাড়াই খুলে দেওয়া হয় নগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ‘শহীদ ওয়াসিম আকরাম ফ্লাইওভার’। নগর পরিকল্পনাবিদেরা র‌্যাম্প নির্মিত হলে মূল সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া ও যানজটের যুক্তি দিলেও, সিডিএর দাবি, এসব র‍্যাম্প করা না হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যাবে। যা আগামীতে নগরবাসীর স্বপ্নের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে গলার কাঁটাতে পরিণত হতে পারে। যদি প্রকল্প অনুযায়ী র‌্যাম্পগুলো বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে পুরো ফ্লাইওভারই অকেজো প্রজেক্ট হিসেবেও পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন সিডিএ ও নগরবাসীদের একটা অংশ।
শুরু থেকে ১৪টি র‌্যাম্প নির্মাণের কথা থাকলেও নানা বাধা ও সিদ্ধান্তের মুখে ৫টি র‌্যাম্পের নির্মাণ কাজ স্থগিত করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ (সিডিএ)। বাকি নয়টি র‌্যাম্পের বাস্তবায়নের কাজ চললেও, অপর্যাপ্ত র‌্যাম্পের কারণে আগামীতে ফ্লাইওভারটির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিডিএর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা সুপ্রভাতকে বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে চালু করা হয়েছে র‌্যাম্প ছাড়াই। প্রস্তাবনা ছিল ১৪ টি র‌্যাম্পের। কিন্তু নানা বাধায় ৬টি র‌্যাম্পের কাজ স্থগিত করতে হয়। বর্তমানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নয়টা র‍্যাম্প হয়েছে। টাইগারপাসের র‍্যাম্পটা কিন্তু এরইমধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জিইসি র‍্যাম্পটাও বাদ দেওয়ার নানা পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। তা যদি হয় তাহলে মানুষ এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে কীভাবে? মানুষ এখন উঠছে মুরাদপুর ও ২ নম্বর গেইট থেকে। তাহলে তো শহরটাকে কানেক্টিভিটির মধ্যে আনতে পারলাম না। যদি এভাবে র‌্যাম্প নিয়ে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়, তাহলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কার্যকারিতা নিয়ে আগামীতে বড় প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।’
এছাড়া বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, সমীক্ষা ছাড়া পর্যাপ্ত র‌্যাম্প নির্মাণ বাদ দিলে এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশযোগ্যতা কমবে। ফলে প্রায় ৪ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নিমিত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সেতুর সুফল থেকে বঞ্চিত হবে নগরবাসী।
সিডিএর তথ্য মতে, নগরীর লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সড়কের সংযোগ করতে আগ্রাবাদে ৪টি; টাইগারপাস, নিমতলা, সিইপিজেড ও কেইপিজেড এলাকায় ২টি করে এবং জিইসি মোড়, ফকিরহাট ও সিমেন্ট ক্রসিং মোড়ে ১টি করে মোট ১৪টি র‍্যাম্প (ওঠা-নামার) নির্মাণের কথা ছিল। গত ২৮ অক্টোবর সিডিএর নবগঠিত বোর্ডের প্রথম সভায় যানজট বৃদ্ধির অজুহাতে ও ব্যয় সংকোচনে ‘অপরিকল্পিত’ উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে ৬টি র‍্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।

র‌্যাম্প কমে যাওয়ায় যা ক্ষতি হতে পারে
বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজারমুখী ফ্লাইওভারে নিমতলা, টাইগারপাস (আমবাগান সড়কে) ও লালখান বাজারে নামার সুযোগ থাকবে। একইমুখী যাত্রীরা পতেঙ্গা ছাড়াও মধ্যপথে কেইপিজেড, সিইপিজেড, নিমতলা দিয়ে উঠতে পারবেন। অন্যদিকে, লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গামুখী ফ্লাইওভারের আগে দুই নম্বর গেইট ও মুরাদপুর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে উঠে সরাসরি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারতেন যাত্রীরা। এর বাইরে শুধু জিইসি ও আগ্রাবাদ ঢেবারপার র‌্যাম্প দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে। আর একইমুখী যাত্রীরা নামতে পারবেন ফকিরহাট, সিইপিজেড আর পতেঙ্গায়।
এছাড়া নগরীর টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড মূল সেতুতে ওঠার র‌্যাম্পটি নির্মাণ না করলে কোতোয়ালি, নিউমার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, চকবাজার, সদরঘাট থেকে আসা যানবাহনগুলো ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে আগ্রাবাদ ঢেবারপাড় দিয়ে উঠতে হবে। যার কারণে যানজট কমবে না বরং এক্সপ্রেসওয়ের সুফল বঞ্চিত হবে মানুষ।
মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আগ্রাবাদে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামা ও আগ্রাবাদের অ্যাক্সেস রোডে ওঠা-নামার দুটি; মোট তিনটি র‌্যাম্প নির্মাণ স্থগিত করায় হালিশহর, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, দেওয়ানহাট, ডবলমুরিং এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রকল্পটির সমীক্ষায় এই এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এছাড়া মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ইপিজেড নামার র‌্যাম্প না করলে শিল্প কারখানা সংশ্লিষ্টরাও বঞ্চিত হবেন সুফল থেকে।
মঙ্গলবার সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে ১৪টি র‌্যাম্পের বিষয় আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ টাইগারপাস ও জিইসি মোড়ের র‌্যাম্প। কিন্তু পরিবেশ রক্ষা কমিটি ও নাগরিকদের বাধার মুখে পড়ছি টাইগারপাসের র‌্যাম্পটি নিয়ে। জিইসি মোড় র‌্যাম্পের কাজ চলমান রয়েছে। এখন টাইগারপাসের র‌্যাম্পটি চালু করতে পারলেই নাগরিকরা কিছুটা যানজট থেকে মুক্তি পেতেন। এককথায় এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পুরোপুরিভাবে পেতে হলে আমাদের বাধ্যতামূলক টাইগারপাস ও জিইসি মোড় এলাকার দুইটি র‌্যাম্প অবশ্যই প্রয়োজন। এছাড়া সময়ের ব্যবধানে ১৪টি র‌্যাম্পই চালু হতে হবে।

জিইসি মোড়ের র‍্যাম্প নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে ফিরছেন মেয়র
এদিকে, জিইসি র‌্যাম্পটি না হলে নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক প্রান্ত ও মুরাদপুরের মোহাম্মদপুর প্রান্ত হয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না। ফলে খুলশী, পাহাড়তলী, নাছিরাবাদ এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী এক্সপ্রেসওয়ের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
তবে গত ১৮ ডিসেম্বর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জিইসি র‌্যাম্পটি নির্মাণ নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার (ইঞ্জিনিয়ার মোশারররফ হোসেন) আশীর্বাদে জিইসি মোড়ে তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান একটি আভিজাত হোটেলের (হোটেল পেনিনসুলা) যাত্রীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য জিইসি র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে কোন নাগরিকসুবিধা নেই।’ এর পরে সিডিএ কর্মকর্তারা এক বৈঠকে বিষয়টি তাঁকে যৌক্তিকভাবে বোঝালে নাগরিক সুবিধার্থে তিনি মত পরিবর্তন করেন।
এ বিষয়ে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়টি নিয়ে সিডিএ কর্মকর্তারা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমাকে বলেছেন, যানজট নিরসনে রাস্তার প্রশস্ততা বৃদ্ধি, গোলচত্বরসহ নানা উন্নয়ন করবেন। নাগরিকদের সুবিধার জন্য নানা ব্যবস্থা নেবেন। যার জন্য বিষয়টিতে আমি নগর পরিকল্পনাবিদদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছি। পরিকল্পনাবিদরা যদি মনে করে জিইসি মোড়ের র‌্যাম্পটি নাগরিকদের উপকারে আসবে, এতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

টাইগারপাসের র‌্যাম্পটিও খুলতে চান সিডিএ
এ প্রজেক্টটি নিয়ে সিডিএর অন্যতম দ্বিতীয় পরিকল্পনা টাইগারপাস র‌্যাম্পটি নির্মাণের কাজও চালু করা। কিন্তু অর্ধ শতাধিক গাছ কাটা পড়বে তাই পরিবেশ চিন্তাবিদদের বাধার মুখে আপাতত কাজটি বন্ধ রেখেছে। তবে সিডিএ চায় এ র‌্যাম্পটিও যেন চালু করা হয়। তাহলে এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পাবে নাগরিকরা।
বর্তমানে সিডিএ যদি এ পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়, আর নাগরিকেরা যদি তাতে বাধা দেন, বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে মেয়র বলেন, ‘শুধু জিইসি ও টাইগারপাস র‌্যাম্প না, হাইওয়ে এক্সপ্রেসওয়ের সকল র‌্যাম্প যদি সিডিএ চালু করতে চায়, আমার ব্যক্তিগতভাবে আপত্তি নেই। এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা নাগরিকরা যেমন ভোগ করবে, কুফলটাও নাগরিকরা ভোগ করবে। তবে আমাকে নাগরিকদের অধিকারের বিষয়টি আগে ভাবতে হবে। আমি পরিকল্পনাবিদদের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত চাইবো। তারা যেন নগরকে বিপদে ফেলে কোন ধরনের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত না নেয়।’

র‌্যাম্প স্বল্পতায় লোকসানে পড়তে পারে উড়াল সেতু
অন্যদিকে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে র‌্যাম্প কম নির্মাণের ফলে আগামীতে কার্যকারিতা, সম্ভাব্যতা ও পরিকল্পনা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন নগরবাসীর।
নগরবাসীর মধ্যে সচেতনমহল মনে করেন, ‘র‌্যাম্প কম নির্মাণের ফলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কার্যকারিতা থাকবে না। জিইসি মোড়ের র‌্যাম্প নির্মাণ না করলে আশেপাশের মানুষকে অনেক দূরে গিয়ে উঠতে হবে। এছাড়া নকশা অনুযায়ী র‌্যাম্পগুলো না থাকলে মানুষ সুফল পাবে না। নিচে যানজট থাকবে। পর্যাপ্ত ওঠা-নামার জায়গা না থাকলে গাড়ি কম চলবে। প্রত্যাশিত গাড়ি না পেলে নির্মাণ খরচ দূরে থাক, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও তোলা কষ্টকর হবে। এটিও কর্ণফুলী টানেলের মতো লোকসানি ভাগ্য বরণ করতে পারে।’
উল্লেখ্য ২০১৭ সালের জুলাই মাসে অনুমোদিত নগরীর লালখান বাজার হতে শাহ্ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের প্রজেক্টটির বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয় । তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ করার কথা ছিল। প্রকল্পটির ব্যয় পাঁচ বছর পর ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হয়। পরবর্তী দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস করা হয়।
এছাড়া নকশা প্রণয়নের সময় অন্য কোনো সংস্থা ও বা অংশীজনদের মতামত না নেওয়ায় পদে পদে আপত্তি আসতে থাকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে আলাপ না করায় জটিলতা দেখা দেয়। নকশা পরিবর্তন, নতুন স্থাপনা যুক্ত, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হলেও ২০২৪ সালের আগস্টে পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হয়। চলতি ২০২৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে টোল আদায় শুরু হয় উড়াল সড়কটিতে।