আলী প্রয়াস »
ফ্রাঞ্জ কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) আধুনিক সাহিত্যের একটি অনন্য নাম, এবং তার সাহিত্যকর্মে যা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তা হলো অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। যদিও কাফকা সরাসরি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ছিলেন না, তার কাজের মধ্যে অস্তিত্ববাদী চিন্তা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অস্তিত্ববাদ এমন একটি দার্শনিক প্রবণতা, যা মানুষের অস্তিত্বের সংকট, একাকীত্ব, অবর্ণনীয় শূন্যতা এবং জীবনের অর্থহীনতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। কাফকার লেখাগুলোতে এইসব বিষয়গুলি অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে ফুটে উঠেছে, এবং এটি তার সাহিত্যকে আধুনিক মানবিক সংকটের এক গুরুত্বপূর্ণ চিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অস্তিত্ববাদী দর্শন মূলত আধুনিক দার্শনিকেরা যেমন সার্ত্র, কির্কেগার্ড, নীৎশে ইত্যাদির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো মানব অস্তিত্বের স্বাধীনতা, অর্থহীনতা এবং জীবনের অসম্ভবতা বা সীমাবদ্ধতা। অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারা মতে, মানুষ নিজেই তার অস্তিত্বের অর্থ সৃষ্টি করে, এবং বিশ্বের কোনও পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য বা দিকনির্দেশনা নেই।
এটি একটি নৈতিকতা বা পরম আদর্শের পরিহারের দর্শন, যেখানে ব্যক্তি তার জীবন ও পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতেও তার কাছে সবসময় একটি শূন্যতা বা অস্থিরতা বিরাজ করে। মানুষের অস্তিত্বের এই সংকটের প্রেক্ষিতে কাফকা এমন এক ধরনের সাহিত্য তৈরি করেছেন যেখানে তার চরিত্ররা নিজেদের অস্তিত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টায়, অথবা সমাজ এবং প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের মুখে নিঃসঙ্গ এবং শঙ্কিত থাকে।
কাফকার সাহিত্যকর্মের মধ্যে যে প্রধান অস্তিত্ববাদী উপাদানগুলি রয়েছে, তা হলো:
কাফকার লেখা প্রায়শই এমন চরিত্রদের কেন্দ্রবিন্দুতে ঘোরে, যারা নিজেদের অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পায় না বা তারাই প্রশ্ন করতে থাকে ‘আমরা এখানে কেন?’ তার গল্পগুলোতে মানুষ কোনো সুস্পষ্ট বা সুষ্পষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য খুঁজে পায় না, যার ফলে তারা জীবনের প্রতি হতাশাগ্রস্ত এবং সংকটে ভোগে। মেটামর্ফোসিস (The Metamorphosis) এর প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা একদিন নিজেকে বিশাল পোকায় পরিণত হতে দেখে। এই পোকায় পরিণত হওয়া শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, বরং তার জীবনের অর্থহীনতা ও তার পরিপার্শ্বের প্রতি অস্থিরতার চরম প্রকাশ। গ্রেগর এর মাধ্যমে কাফকা অস্তিত্বের শূন্যতা এবং অজ্ঞতা দেখান, যেখানে চরিত্রটি একদিন উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমি কেন বেঁচে আছি?’ এই বাস্তবতা থেকে কোনো পরিত্রাণ বা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং সে শুধু নিজের পতন দেখবে।
কাফকার গল্পে চরিত্ররা সাধারণত এক ধরনের ‘অথর্ব’ পরিস্থিতিতে থাকে, যেখানে তারা কোনও শক্তি বা প্রভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। দ্য ট্রায়াল (The Trial) উপন্যাসে, জোসেফ প্রধান চরিত্র, তার নিজের বিচারকের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়তে পারে না, কারণ তিনি জানেন না কেন তাকে নিয়ে বিচার করা হচ্ছে বা তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ রয়েছে কি না। এই অবিচ্ছিন্ন অবস্থা ও নিস্প্রভতা অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় যেখানে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং তার জীবন এবং তার বিচার প্রক্রিয়া অজ্ঞাত এবং অসীম।
কাফকার অনেক চরিত্রই একাকী, নির্জন এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। তারা জীবনের মর্ম বোঝে না, তারা নিজেদের ইচ্ছা ও আশা নিয়ে চলতে থাকে, কিন্তু তারা জানে না কোথায় যাবে বা কেন যাবে। দ্য ক্যাসেল (The Castle) এবং দ্য ট্রায়াল গল্পগুলির মধ্যে এক ধরনের অব্যক্ত একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, যেখানে মূল চরিত্রটি একটি পুরানো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেকে একটি অদৃশ্য এবং অসম্ভব কাঠামোর মধ্যে আটকা পড়তে দেখছে।
কাফকা তার সাহিত্যকর্মে মানুষের অস্তিত্বের অস্থিরতা ও শূন্যতার অনুভূতি ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন। তার চরিত্ররা কখনও তাদের পরিস্থিতি এবং পরিণতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে না। তারা প্রায়শই সন্দেহে থাকে, এবং জানে না তারা ঠিক কী চায়, তাদের সত্যিকার উদ্দেশ্য কী, বা তাদের জীবন কতটা অর্থবহ। এভাবেই কাফকা অস্তিত্ববাদী চেতনার মধ্যে মানব অস্তিত্বের যে অনিশ্চয়তা এবং অস্পষ্টতা রয়েছে তা খুব নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
কাফকার ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক দিক থেকে অস্তিত্ববাদী চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। তার নিজস্ব জীবনে হতাশা, একাকীত্ব, এবং পরিবারের সাথে সম্পর্কের জটিলতা ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মেশে। কাফকার পিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ, যা তাকে এক ধরনের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষের মধ্যে ফেলে রেখেছিল। তার আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং তার লেখালেখির প্রতি অবিশ্বাস তাকে আরও বেশি শূন্যতা ও অস্তিত্বের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
কাফকা কখনোই তার সাহিত্যকর্ম বা জীবনে কোনো পরিপূর্ণতা বা নিশ্চয়তা খুঁজে পাননি। তার কাজগুলো যেন নিজেই তার জীবনের এক অন্ধকার দিকের প্রতিনিধিত্ব একটি এমন জীবন যেখানে মানুষ কোনো না কোনোভাবে, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই স্রোতের মতো এগিয়ে চলে, শুধুমাত্র শেষের দিকে তার অস্তিত্বের অর্থহীনতা উপলব্ধি করে। এটি তার সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণের একটি এক গভীর চিত্র, যেখানে কাফকা আমাদের শিখিয়ে যান, জীবনের মর্মের খোঁজে, কখনও কখনও, প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই। ফ্রাঞ্জ কাফকা একজন আধুনিক অস্তিত্ববাদী লেখক হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত। তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণার, একাকীত্বের, এবং অস্তিত্বের অর্থহীনতার সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটে, তা ২০ শতকের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কাফকা তার চরিত্রদের মধ্য দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন যে, পৃথিবীতে কোনও সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য বা আলোকিত পথ নেইÑমানুষ নিজেই তার অস্তিত্বের অর্থ সৃষ্টি করে এবং এক অসীম, অনিশ্চিত জীবনের মধ্য দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হয়।