অমল বড়ুয়া
ইদানিং ভয়টা খুব পেয়ে বসেছে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো প্রতি রাতে মনের গহিনে ভয় বাড়ে। দিনের ঝলমলে আকাশে ভাসতে থাকা মেঘের মতো মনের কোণে ভয় ভাসে। হাঁটতে হাঁটতে পথের মধ্যে ভয় এসে হাত ধরে। সখ্য গড়ে তুলতে হাসিমুখে কথা বলে। বন্ধু হওয়ার আবদার করে। মনের ভেতর বিছানা পেতে একটু বসতে চায়। এড়িয়ে যেতে চাইলে মন আর শরীরকে নাড়িয়ে দিয়ে পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকতে চায়। খুনসুটি করে বুকের ভেতর শিহরন জাগায়। নিজের ছায়ার সাথি হয়ে চলতে চলতে ভয়ের ভেতর কবে তলিয়ে যাই ঠিক বুঝতে পারি না।
ঘরের মেঝে পাতা পালংকখানা কারো ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলে বুকের মধ্যে কাঁপন জাগে। ছটফটানি বেড়ে যায়। মাথাটা হালকা হয়ে যায়। দমবন্ধ হয়ে আসে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। শ^াস-প্রশ^াসের গতি বাড়ে। শরীরটা শূন্য হয়ে বাতাসে ওড়ে। হৃৎপি-ের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। ছেলেরা আমাকে ভয় দেখায়। খেপায়। পালংকে ঝাঁকানি দেয়। আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠি। যেমন ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেছিলাম ২৬ নভেম্বর ২০২১ সালের ভোর পাঁচটায় মনের ভেতর ত্রাস ছড়ানো ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পনের ধকল সইতে না পেরে। মনে হচ্ছিল ভূকম্পনের প্রচ-তায় বিল্ডিংটা পেঁপের ভরে গাছের ডগা ভাঙার মতো ভেঙে পড়বে। প্রতিটি দোলায় মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে আমাকে নিয়ে বিল্ডিংটা রাস্তায় ধপাস করে পড়ে যাবে। সেই থেকে কাঁপনের ভয়টা নিয়ত আমাকে তাড়ায়। একটু কোথাও কাঁপন হলে আমি যমদূতের গান শুনতে পাই।
জন্মের সময় ভয় ছিল কিনা জানি না। তাই বলা যাচ্ছে না ভয় নিয়ে জন্ম নিয়েছি কিনা! কৈশোরের বাড়ন্ত সময়ে কত দুরন্তপনায় কেটেছে সময়। বিল্ডিংয়ের কার্নিশে, উঁচু দেয়ালে কিংবা সাইকেলের প্যাডেলে অথবা খেলার মাঠে অসম সাহসে নিজের জাত ছিনিয়ে ছিলাম। খালের উঁচু ব্রিজ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়া, চারতলা বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে বালির স্তূপে নামা অথবা গাছের ডালে ডালে বিচরণ ছিল একেবারে মামুলি ব্যাপার। এখন উঁচুতে উঠলে আমার হৃৎকম্পন বেড়ে যায়। মান্দালয়ের পোপা টং ক্লাতে উঠতে গিয়ে আমার দশা বিদিশা হবার জোগাড়।
আমার ছেলে অরিজিত বলল, ‘উচুঁতে যাদের ভয় তাদেরকে কী বলে জানো? অ্যাক্রোফোবিয়া।’
এখন আমি উঁচুতে ওঠার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়েছি। উঁচুতে উঠবো কী! ওপরে উঠতে দেখলেই অর্ধপথ থেকে হেঁচকা টানে নিচে ফেলে দিতে কতজনা আছেন অপেক্ষায়।
ইদানিং উচ্চশব্দও সহ্য হয় না। কোনো বিকট শব্দ হলে ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। শরীর অবশ হতে শুরু করে। অন্তর শুকিয়ে যায়। পানির তেষ্টা লাগে। যার কারণে আমি সভা-সমিতিতে যাওয়ার ব্যাপারে নেতিবাচকতায় ভুগি। চেষ্টা করি গান-বাজনার উচ্চ শব্দ এড়িয়ে চলার। অবিরাম চলতে থাকা দীর্ঘকথনের আলোচনা সভা কিংবা কথার ফুল ফুটানো সেমিনার সিম্পোজিয়াম অথবা জ¦ালাময়ী কথামালার স্ফুলিঙ্গে উর্বর রাজনৈতিক জনসভায় যেতে ভয় লাগে। কখনো-সখনো অতিকথকের মিষ্টিকথার বকবকানিও বুকের গভীরে ক্ষত জাগায়। টক- শোয়ের অতিবিনোদনে চোখের কোণে ঘুম নামায়। বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে সগৌরবে ফাটানো পটকাবাজির শব্দে বাড়ে বুকের ধুকপুকানি।
হাসনাত বলল, ‘শব্দের ভয়ে মানুষ কী আর কুয়োয় লুকায়?’
আসলে অসহ্য হলেও শব্দের বুদবুদ থেকে রক্ষে নেই কারো। গ্রাম-গঞ্জ-শহরে মাইকের শব্দে কোলের শিশু কেঁদে ওঠে। বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান চাচার হার্ট বিট বাড়তে বাড়তে অসীমে পৌঁছে যায়। অতঃপর শব্দ খেয়ে নেয় তার জীবনপ্রদীপ। শহরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো গাড়িরা বায়ুদূষণের পাশাপাশি শব্দসৃষ্টির মননশীল খেলায় দিনরাত মত্ত। সয়ে-না-সয়ে সাধারণ নাগরিক কাহিল। শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সবার কান ঝালাপালা। নিশ^াসে সবার বিষ। তবু নির্বাক, বেহুঁশ আর নিষ্পলক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সর্বংসহা নাগরিক দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে জীবন। দূষণ আর শব্দেরা খেয়ে নিচ্ছে প্রতিটি ক্ষণ আর ভবিষ্যত। আমি শব্দকে ভয় পাই। তেতিয়ে আমাকে আমির বলল, ‘শব্দে আপনার কী সমস্যা, অ্যাঁ! আর কারো তো কোনো কমপ্লেইন নেই।’
ভাবি, ‘কেবল আমিই মনে হয় অ্যাকোস্টিকোফোবিয়ায় ভুগছি।’
মাঝে-মধ্যে ঘুমের বেঘোরে স্বপ্ন দেখি। একটা সাপ আমাকে তাড়া করছে। আমি ভয়ে লাফিয়ে কখনো গাছে চড়ছি নয়তো দৌড়ে পালাচ্ছি। আর ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কোনো খাদে পড়ে গেছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আমি অনুভব করি আমার পালপিটিশন বেড়ে গেছে। শরীরে ঘাম ঝরছে। মুখটা বাঁকা হয়ে গেছে। মনটা কেমন বিষিয়ে আছে। থরথর করে শরীর কাঁপছে। ভয়ে আমি হয়ে পড়েছি কোণঠাসা। আমার বউকে বলতেই উচ্চকিত হয়ে সে বলে, ‘বলিও না, আর বলিও না। পেছনে শত্রু লাগছে। আমাদের ভালো থাকা ওদের সহ্য হচ্ছে না।’
ফ্যাকাসে মুখটাকে সহজ করে কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কেমনে বুঝলা শত্রু পেছনে লাগছে !’
সে আাী একটু বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘সাপ স্বপ্নে দেখলে শত্রু বাড়ে।’
আমি মনে মনে বললাম, ‘পশ্চিমাস্মিং দিশা ভাগে সন্তি নাগা মহিদ্ধিকা তে পি মং অনুরকখন্তু …।’
সাপ আমার বুকে ভয় ধরায়। আমি বুঝলাম, আমার মধ্যে অফিডিফোবিয়া আছে। না থেকে তো উপায় নেই। বউয়ের কথাই ঠিক। আপনি ভালো থাকলে আপনাকে কষ্টে ফেলতে কত কারিশমা যে কতজনে করে তার ইয়ত্তা নেই। কথায় বলে, ‘সুখের কথায় হিংসে করে; দুঃখের কথায় সুযোগ খোঁজে।’ তাই বলে কী শত্রুর ভয়ে আর গর্তে লুকাবো !
গর্তেও আমার ভয় আছে। খবরে দেখলাম, ম্যানহোলে পড়ে শিশুর মৃত্যু। প্রাচীন প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন পর্যটনে দেখা মেলে ছোট ছোট কামরা। সেই কুঠুরিতে ধ্যানমগ্ন থাকতেন সাধকগণ। গর্ত কিংবা সেই ছোট কুঠুরির কথা মনে উঠলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে ভয় জাগে। পড়েছিলাম বাদশাহ কর্তৃক রানিকে জীবন্ত কবর দেওয়ার কাহিনি। তাতে শিহরিত হই। আমি বুঝতে পারি আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে। সেদিন সাউথ ইন্ডিয়ান এক সিনেমায় জেলের অন্ধকার কারার দৃশ্য দেখে আমার প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার উপক্রম।
আমার ছেলে অরিজিত বলল, ‘জানো বাবা, আমার কিসে কিসে ভয়?’
আমি হতাশ হয়ে বললাম, ‘ভয় পাবার কি আছে বাবা?’
ছেলে ভয় পেলে আমার মতো দুর্বল বাবার মনেও কাঁপন জাগে। অরিজিত উত্তরে বলল, ‘এই ধরো তোমার যেমন উচ্চতায় ভয় …!’
আমি ভড়কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কিসে ভয় …?
অরিজিত নির্দ্বিধায় বলা শুরু করলো, ‘তোমার মতো আমিও উচ্চতায় ভয় পাই। সমুদ্রের অজস্র জলরাশি দেখলে ভয় লাগে। পোকামাকড় দেখলেও ভয় লাগে।’
তারপর একটু থেমে বলল, ‘জল থেকে ভয় পাওয়াকে কি বলে জানো, অ্যাকোয়াফোবিয়া।’
আমি একটা দীর্ঘশ^াস ফেললাম। অরিজিত আবার বললো, ‘একা থাকতেও আমার ভয় লাগে। আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারি না।’
আমি বুঝলাম আমার ছেলের অটোফোবিয়া আছে। মনের ভেতর গুড়–ম গুড়–ম করছে। আমার এতটুকু বাচ্চার মাঝেও ভয় আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, তোমার আর কোনো ভয় নেই তো?’
অরিজিত হেসে বলল, ‘বাবা, আমার কিন্তু ভূতের ভয় আছে। মানে ডেমোনোফোবিয়া।’
আবার বলল, ‘শোনো আমার কিন্তু এলিয়েনেরও ভয় আছে।’
আমি দুষ্টুমির স্বরে বললাম, ‘বইয়ের ভয় নেই তো?’
ও হেসে বলল, ‘বইয়ের ভয় মানে বিবলিওফোবিয়া …
বর্তমানে যে হারে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল হচ্ছে তাতে কিছু খেতে ভয় হয়। খাওয়ার পরও ভয় হয়। পেট খারাপে বা রোগব্যাধিতে ঔষধ খেতেও ভয় হয়। কারণ ঔষধেও ভেজাল হয়। চিকিৎসায় লোকঠকানোর বিস্তর কাহিনি চাউর আছে। পথেঘাটে-মাঠে চলতে-ফিরতে ভয় পাই। ছিনতাইকারীর ভয়। মলম পার্টির ভয়। চোর-বাটপার আর প্রতারকের ভয়। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে কিংবা ইভটিজিংয়ের বাড়-বাড়ন্তে সমাজেও বাড়ছে ভয়। বাজারে জিনিসের চড়া দামে নাভিশ^াস সাধারণের। এখন বাজারে যেতেও লাগে ভয়। নিত্যদিনের এই ভয়ে মনের কোণে জলোচ্ছ্বাসের মতো বাড়ে দুশ্চিন্তা। সৃষ্টি হয় মনে অশান্তি। সুখ হয় ফেরার। বাড়ে চাপ ভেতরে-বাইরে। আর সেই চাপে যাপিত জীবনের আনন্দ নিঃশেষে হারিয়ে যায় নিরুদ্দেশে।