রাজিব শর্মা »
একটি ধর্মীয় সংগঠনের নামে ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে নগরীর হাজারী গলিতে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের ঘটনায় সেনা সদস্যরা গতকাল সেখানকার সব দোকানপাট ‘সিলগালা’ করে বন্ধ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ অজ্ঞাত ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে এ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হাজারী গলি মিয়া শপিং সেন্টার নামের একটি মার্কেটের একটি দোকানের মালিক ওসমান
মোল্লা ফেইসবুকে হিন্দুদের ধর্মীয় একটি সংগঠন ইসকনকে নিয়ে ‘ব্যাঙ্গাত্মক’ পোস্ট করেন। এ নিয়ে স্থানীয় সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে বিক্ষুব্ধরা দল বেঁধে মার্কেটের সামনে জড়ো হয়। তারা দোকানটি ঘিরে রাখে। পরে পুলিশ গিয়ে পোস্টদাতা ওসমানকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় পুলিশকে ধাওয়া করেন স্থানীয় লোকজন। বিক্ষুব্ধরা বাহিনীর সদস্যদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। উপর থেকে অ্যাসিডও নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচ সেনা ও সাত পুলিশ সদস্যসহ ১২ জন আহত হয়েছেন ।
গতকাল বিকেলে নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন।
হামলার অভিযোগে গতকাল দুপুরে কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান বাদি হয়ে এসিড দমন আইনে মামলাটি দায়ের করেন। এ ঘটনায় প্রথমে ৮২ জনকে আটক করা হয়। পরে ৩৩জনকে ছেড়ে দেয়া হয়।
গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় সুপ্রভাতকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. তারেক আজিজ। তিনি বলেন, হাজারি লেনের ঘটনায় আটককৃত ৮২ জনের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৩৩ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ অজ্ঞাত ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ৪৯ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
এদিকে গতকাল বেলা ১২টায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কার্যালয়ে পৃথক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন যৌথ বাহিনী। সেখানে পুরো ঘটনা তুলে ধরেন কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ।
লিখিত বক্তব্যে কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৫টায় ওসমান আলী নামের একজন ব্যক্তির ইসকনবিরোধী একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর টেরীবাজার এলাকার হাজারী লেনে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আনুমানিক ৫০০ থেকে ৬০০ জন দুষ্কৃতকারী হাজারী লেনে ওসমান আলী ও তার ভাইকে হত্যা এবং দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হন। স্থানীয় কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবি সদস্যদের ৬টি টহল দল উক্ত এলাকায় পৌঁছায়। বিশৃঙ্খলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জানমাল রক্ষা এবং মব জাস্টিস রোধে যৌথবাহিনী ওসমান আলী ও তার ভাইকে উক্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করেন।
উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানের বিষয়টি আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে উগ্র বিশৃঙ্খলাকারীরা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে জানিয়ে কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ আরও বলেন, ‘দুর্বৃত্তরা এ সময় যৌথবাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড হামলা চালায় এবং ভারী ইট-পাটকেলসহ ভাঙা কাঁচের বোতল ছুঁড়তে শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর ৫ জন সদস্যসহ ৭ পুলিশ সদস্য আহত হন। সেনাবাহিনীর ৫ জন সদস্যকে বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, চট্টগ্রামে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও, ঘটনাস্থলে দুর্বৃত্তরা ইট ছুঁড়ে সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ভ্যানের উইন্সিল্ড ভেঙে ফেলে।’
উদ্ধার অভিযানের পর দুর্বৃত্ত শনাক্তকরণে যৌথবাহিনীর ১০টি টহল দল রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাজারী লেনে গেলে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতকারীরা পুনরায় যৌথবাহিনীর ওপর এসিড সদৃশ বস্তু ছুড়তে শুরু করেন বলে জানান কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, ‘এসময় যৌথবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে ৮০ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করে। বর্তমানে বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাচাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আটককৃত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট থানায় প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদসহ যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে হস্তান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং হাজারী গলিসহ নগরীর অন্যান্য এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এদিকে ঘটনার বিষয়ে ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও হিন্দু গণজাগরণ মঞ্চের মূখপাত্র চিন্ময়ানন্দ প্রভু ওরফে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রকৃত ঘটনা ইসকনের বিরুদ্ধে একটি ফটোকার্ড ছড়িয়েছিলেন, সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হয়তো ক্ষোভের কারণে কেউ কেউ আইন প্রশাসনের ওপর অন্যায়ভাবে হামলা করেছে। এটির বিচার আইন করবে। এটি আইনের বিষয়। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।