শওকত এয়াকুব »
কায়কোবাদ প্রেম ও প্রকৃতির কবি। প্রেমকে উপজীব্য করেই তাঁর কাব্যসাধনা। তাঁর গীতিকাব্যের বেশির ভাগই প্রেমের।এসব কবিতায় শৈশবের প্রেম, স্মৃতিচারণ, বিরহের যন্ত্রণা, প্রিয়া হারানোর বেদনা, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনের যন্ত্রণা, অবিশ্বাস, সন্দেহ প্রভৃতি প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।তাঁর কিশোরকাব্যে এর প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি। তিনি তাঁর প্রেয়সীর সাথে যে সুন্দর দিনগুলো কাটিয়েছেন তা তাঁকে তাড়িত করেছে। কবি তাঁর প্রণয়ীকে নিয়ে শুধু আলাপনে মশগুল থাকেননি। নির্জন-নির্ভত কুঞ্জবনে তাঁরা পরস্পরকে প্রেমমাল্য পরিয়ে ভালোবাসাকে করেছেন তীব্রতর। কবি তাঁর প্রেম-ভালোবাসাকে নিষ্কলুষ ও পবিত্র বলে উল্লেখ করেন।এই পবিত্র ভালোর মর্যাদা কবি রক্ষা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। কবির ভাষায় :
আমাদের ভালোবাসা বিশুদ্ধ বিমল
কলুষের লেশমাত্র লাগিতে না দিব,
পবিত্র পৃথিবী মুখ করিবে উজ্জ্বল
হৃদয় মন্দিরে সদা লুকায়ে রাখিব।
কবি প্রিয়ার প্রতি অভিমান করে বলেন যে, তিনি কিছুদিন কষ্ট ভোগ করবেন, ধৈর্যধারণ করবেন। অতঃপর প্রিয়াকে ভুলে যাবেন। আর কোনদিন প্রিয়াকে স্মরণ করবেন না।এমনকি প্রেম-ভালোবাসায় আর কোনোদিন আত্মাহুতি দেবেন না।কবি প্রেয়সীকে বলেছেন চুপ থাকতে, ভালোবাসা প্রকাশ না করতে, ভুলে থাকতে। আর তিনিও ভুলে থাকবেন, পরজগতে তাদের মিলন হবে। কিন্তু তিনি জগৎ সংসারের সবখানে প্রণয়ীর মুখ দেখতে পান।তিনি তাকে শত চেষ্টা করেও ভুলতে পারেন না। কবির ভাষায় :
কি হইবে? কিছু দিন জ্বলিবে এ-মন
অবশেষে ক্রমে ক্রমে ভুলিব তোমায়
না বহিবে ভালোবাসা, সুখের মনন
মজিব না কভু প্রণয়-মায়ায়।
যখনি ভুলিতে চাই
তখনি দেখিতে পাই
আকাশ-পাতাল তব সেই মুখখনি
সেই মুখ বিনে আর কিছু না জানি।
কায়কোবাদ প্রেমের কবিতায় বাঙালি কবির ঐতিহ্যের পথ ধরেই প্রিয়ার রূপ বর্ণনা করেছেন।প্রিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। মিলনে হয়েছেন উৎফুল্ল, কখনওবা আক্ষেপ, অভিমান করেছেন, বিরহ-ব্যথায় কাতর হয়ে করেছেন বিলাপ, প্রিয়াকে ছলনাময়ী বলেছেন। কখনও অতীত প্রেম সুখস্মৃতি রোমান্থন করে ব্যথিত হয়েছেন। অশ্রু বিসর্জন করেছেন। কবির প্রেমভাবনা একান্ত মানবীয় আবেগে ভরপুর। প্রেমানুভূতির নিবিড় প্রগাঢ়তায় তাঁর কবিতা উজ্জ্বল ও জীবন্ত।
কবির বাল্যপ্রণয়ী গিরিবালা দেবীকে কবি কোহিনূর মণির সাথে তুলনা করেছেন। গিরিবালা কবির জন্য ফুল পাঠাতেন, ফুল দিয়ে বরণ করতেন। তাই কবি তাকে ‘ফুল্লকমলিনী’ বলে অভিহিত করেছেন। কবি তাঁর প্রণয়ী গিরিবালাকে হারিয়েছিলেন ধর্মের ভিন্নতা আর সমাজ সংস্কারের কারণে। কবির ভাষায় :
কোথায় আমার সেই ফুল্ল কমলিনী
যাঁহার প্রেমের স্মৃতি
জাগে প্রাণে নিতি নিতি
কোথায় আমার সেই কোহিনূর মণি।
(সোহাগিনীি প্রয়া)।
তুমি ছিলে ব্রাহ্মণ-কন্যা আমি ছিনু মুসলমান
কে জানিত দোহার মাঝে এতখানি ব্যবধান
(উষাস্বপ্ন)
নারীর রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনা বাংলা কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। বেশির ভাগ কবিই প্রণয়িনীর অপরূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে তা বর্ণনা করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। কায়কোবাদ-এর প্রণয়িনী রূপে-গুণে অতুলনীয়া, শ্রেষ্ঠ রমণী। কায়কোবাদ তাঁর কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় প্রণয়িনীর অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। আমার প্রিয়া, উষাস্বপ্ন, প্রেম-প্রতিমা, প্রেমের স্মৃতি, উদাসীন প্রেমিক প্রভৃতি কবিতায় কবির প্রণয়িনীর সৌন্দর্য অসাধারণ মুনশিয়ানায় রূপায়িত হয়েছে।কবি তাঁর প্রণয়িনীকে সকল নারীর সেরা মনে করেন। তাঁর প্রিয়ার অপরূপ সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে কবি বলেন :
আমার প্রিয়া সকল নারীর সেরা।
চাঁপার বরণ রংটি তাহার
ছড়িয়ে পড়ে রূপের বাহার
জগৎভরে নাই তুলনা ফুল দিয়ে তা গড়া।
(আমার প্রিয়া)
আঁখি দু’টি কি সুন্দর, সুধা ঝরে ঝরঝর
হৃদয়মাতানো চারুপ্রেমের ফোয়ারা।
(পাষাণময়ী)
কবি ভেবেছিলেন প্রেয়সীকে ভুলে যাবেন। স্বস্তিতে থাকবেন তিনি। কিন্তু শত চেষ্টা করেও প্রিয়তমাকে ভুলতে পারছেন না। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে মৃত্যুর মুখেও তাকে ভোলা সম্ভবপর নয়। কবির হৃদয় অদৃশ্য অনলে দগ্ধ হতে থাকে। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয় হৃদয়-মানস। তবুও প্রিয়াকে ভুলতে পারেন না। কবি নিজেই প্রশ্ন করেন কিভাবে তিনি প্রিয়াকে ভুলতে পারবেন? কবি বলেন :
আমার প্রাণের মাঝে যে অনল গো
কেমনে নিভাই আমি তারে
ভুলি ভুলি করি আমি, ভুলিতে পারি না গো
কেমনে ভুলিব আমি তারে।
কবি প্রিয়াকে ভুলতে পারছেন না।কিন্তু প্রিয়া অন্যের ঘরনি হয়ে ঠিকই তাকে ভুলে গেলেন। কবি কখনও ভাবেননি তাঁর প্রণয়িনী এতো পাষাণময়ী হতে পারে। প্রিয়া কবির ডাকে সাড়া না দেওয়ায় এবং অবলীলায় তাঁকে ভুলে যাওয়ায় প্রিয়ার প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। কবি সংশয়ে পড়ে যান। তাহলে কি প্রিয়া প্রেমের অভিনয় করে তাকে ফাঁকি দিয়েছে। অতঃপর কবি প্রিয়াকে অভিযুক্ত করছেন ছলনাময়ী হিসেবে প্রিয়ার প্রতি সন্দেহ, অভিযোগ, হতাশা ও অভিমান কবিকে সমগ্র নারীজাতির ওপর আস্থাহীন করে তুলেছে। ক্ষুব্ধ, হতাশ কবি নারীজাতির মধ্যে ‘ছলনা’ দেখতে পেয়েছেন।
‘প্রেমের সে স্মৃতি’ কবিতায় কবি বলেন :
বুঝিলাম এ জগতে কপট রমণী জাতি
পাষাণে গঠিত হৃদে নাহি স্নেহ-কণা
মুখেতে মধুর হাসি, অন্তরে গরল রাশি
দেবী বেশে যেন তারা সাক্ষাৎ ছলনা।
কবি কায়কোবাদের প্রেমে আবেগ আছে, বিরহের যন্ত্রণা আছে, কান্না ও হতাশা আছে। কিন্তু অসংযম ও অনাচার নেই। বরং এক নৈতিক মূল্যবোধ, অন্তরের বিশ্বাসজাত প্রত্যাশা তাঁর প্রেমিকসত্তাকে করেছে সুস্থির, সহনশীল, প্রত্যয়ী ও আশাবাদী।