সুভাষ দে <<<
তিনি সাংবাদিক, গবেষক এবং প্রজ্ঞাবান সমাজচিন্তক। আমাদের চারপাশের অসংগতি, কুসংস্কার, সামাজিক জড়তার পরিবর্তনে লেখালেখিকেই হাতিয়ার করেছেন। লেখায় তিনি জনমত সংগঠিত করেছেন। রূপান্তরের বাণী তাঁর লেখায় বিধৃত, সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ায়ও এ লক্ষ্যে ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার উপ বার্তা সম্পাদক। গবেষণা, সামাজিক কাজ এবং মানুষকে মানবিক, সংবেদনশীল করে তুলতে সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকাও নিয়েছেন।
সুপ্রভাত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি সম্পাদক হিসেবে এ পত্রিকায় যুক্ত হন। আমি পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। কবিÑসাংবাদিক আবুল মোমেন আমাকে এই পত্রিকায় নিয়ে আসেন। সম্পাদকীয় বিভাগ দেখতেন ইদ্রিস ভাই। পত্রিকা পাঠকের হাতে যাওয়ার দুই মাসের মধ্যেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। আমার ওপর ঐ বিভাগের দায়িত্ব এসে পড়ে। এ কাজে আমার পেশাদারিত্বের বিষয়টি গড়ে দিয়েছেন মকসুদ ভাই। আমি সম্পাদকীয় লিখে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি পত্রিকার নীতি আদর্শ, লেখার কৌশল, শব্দ প্রয়োগ এবং লেখকের অভিমত প্রকাশ, জনরুচি ও চাহিদা অনুসারে বক্তব্য বিন্যস্ত করতে সহায়তা করতেন। তিনি রিপোর্টিং, ফিচারে বাহুল্য বর্জন করে, অহেতুক মেদ কমিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দিতেন। বানান রীতিতে তিনি প্রমিত রূপকেই পছন্দ করেছেন, তবে যে সকল শব্দ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, মানুষের কথার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে সে শব্দের বানানরীতি অবিকৃত রাখতে বলতেন, যেমন কর্ণফুলী, ফেনী কিংবা রাজশাহী, গোমতী এগুলিতে তিনি ‘’ি কার দেওয়ার পক্ষপাতী নন। আমাদের পত্রিকায় বেশ কয়েকজন তরুণ লেখক, সংস্কৃতিকর্মী কাজ করতেন। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা একটা মানে নিয়ে যেতে সুপ্রভাত অবদান রাখুকÑএটা তিনি চাইতেন এবং এ ব্যাপারে তিনি আশাবাদীও ছিলেন। ধর্মীয় যে সব লেখা আসতো, আমার সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ সহÑসম্পাদক ইব্রাহিম সাহেবকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সম্পাদনার জন্য। এর ফলে আমার জন্য সুবিধা হয়েছে।
ইরাকে মার্কিন ও পাশ্চাত্য আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিনি পাশ্চাত্যের পোশাক বর্জন করেছিলেন, দেশীয় মিলের ও খদ্দরের সাদা কাপড় পরতেন। জীবনযাপনে তিনি অত্যন্ত পরিমিত ছিলেন। লেখালেখি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন। আমাদের গবেষণা সাহিত্য তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। যুক্তি, রুচি সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতেন। আদিবাসী, সংখ্যালঘু, প্রান্তিকÑদলিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন। কোন কোন সময় অনশনও পালন করেছেন। অহিংসা ও ন্যায়বোধে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। আমাদের দেশে গান্ধীর জীবন ও দর্শন আলোচনায় তিনি একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। এ কারণে ভারতের রাজনৈতিক সামাজিক মহলেও তিনি সম্মান, সমাদর পেয়েছেন। দেশ বিভাগের ওপর তিনি বিভিন্ন জনের কয়েক হাজার চিঠি সংগ্রহ করেছেন। কয়েকটি পত্রÑপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। এগুলি নিয়ে একটি বড়ো বই প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের সাহিত্য, গবেষণা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে দীন করেছে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ