প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ

আমার প্রথম বই

ওমর কায়সার »

আশির দশকে দৈনিক পূর্বকোণে চাকরি নেওয়ার আগ পর্যন্ত সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিন আমাদের সময় কাটত রাজপথে মিছিলে, মিটিংয়ে। কিন্তু সপ্তাহের একটি দিন সকল কোলাহল থেকে সরে আমরা জড়ো হতাম ডিসি পাহাড়ের সামনে ফুলকির একটি নির্জন কক্ষে। সারা সপ্তাহে মিছিল আড্ডার অবসরে যে যা লিখেছি তা পকেটে পুরে নিয়ে আসতাম অচিরা পাঠচক্রের নিয়মিত বৈঠকে। দুরু দুরু বক্ষে কম্পিত হস্তে পকেট থেকে লেখাটা বের করে পড়া শুরু করতাম। তারপর শুরু হতো সেই লেখার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার। কেউ শব্দব্যবহার নিয়ে, কেউ ছন্দ নিয়ে, কেউ বিষয় নিয়ে। সমালোচনার চেয়ে পরামর্শ থাকত বেশি। মোমেন ভাই মানে কবি আবুল মোমেন ছিলেন এই পাঠচক্রের উদ্যোক্তা। তিনি নিজেও লেখা পাঠ করতেন এবং উপস্থিত সবার লেখা সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন। সব শেষে মোমেন ভাই বিখ্যাত লেখকদের কালজয়ী সব লেখা থেকে আমাদের পাঠ করে শোনাতেন। পাঠচক্রে প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক ও কবি তপন জ্যোতি বড়ুয়াও যেতেন। আমাকে ছন্দ শিখিয়েছেন কবি তপন জ্যোতি বড়ুয়া। তো অচিরা পাঠচক্রে পঠিত কবিতাগুলো নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম কবিতার বইটি।
একদিন মোমেন ভাই বললেন, অনেকদিন তো হলো। এবার তোমাদের বই প্রকাশের সময় এসেছে। মোমেন ভাইয়ের কথায় খুব উৎসাহিত হলাম। কিন্তু নিজের লেখাগুলোকে গ্রন্থিত করার জন্য একসঙ্গে জড়ো করব, সেই শৃঙ্খলাটুকু আমার ছিল না। আমি একদিন বিচ্ছিন্ন কাগজে লেখা সব কবিতা ভাঁজ করে নিয়ে মোমেন ভাইয়ের হাতে দিয়ে আসলাম। তিনি সেগুলো যথাযথ শৃঙ্খলায় সম্পাদনা করলেন। শব্দ বদল করলেন, শব্দ যোগ করলেন।
পাণ্ডুলিপি তৈরি। এবার বই প্রকাশের পালা। অচিরা পাঠচক্রের নিয়মিত সদস্য কবি শ্যামল দত্ত তখন সবে মাত্র চট্টগ্রাম ছেড়েছে। গায়ে তখনো রাজধানীর গন্ধ লাগেনি অর্থাৎ কর্মজীবনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়েনি। সে বলল, আমি তোমার বইটি ঢাকা থেকে প্রিন্ট এবং বাইন্ডিং করে আনব। ব্যাস, আমার দায়িত্ব শেষ। শ্যামল পাণ্ডুলিপি ঢাকায় নিয়ে গেল। কদিন পর উন্নত অফসেট কাগজে ছাপল, যুৎসই বাঁধাই করল। অচিরা পাঠচক্রের আরেক সদস্য শিল্পী ছড়াকার শৈশবের বন্ধু উত্তম সেন বইটির প্রচ্ছদ আর অলংকরণ করেছে। সে ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তখন মাথায় আসত না। বইটির প্রিন্টার্স লাইনে লেখাগুলো এরকম- অচিরা পাঠচকের পক্ষে শ্যামল দত্ত কর্তৃক ফুলকি ৪৬ বৌদ্ধ মন্দির সড়ক, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত। প্রকাশকাল ১৯৮৮।
অচিরা পাঠচক্রের দীর্ঘ এক দশক ধরে আমাদের সাহিত্য আড্ডার মুদ্রিত সাক্ষী হয়ে রইল আমার কবিতার বইটি। বইটির দাম ছিল ১৫ টাকা।
একদিন সকাল বেলা তরতাজা অনেকগুলো প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ নিয়ে শ্যামল বাসে চেপে চট্টগ্রাম চলে আসে। প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ প্রকাশে তাই আমার কোনো দুঃখ পেতে হয়নি। কিন্তু বইটি প্রকাশের পর আমার জন্য একের পর এক চমক অপেক্ষা করছিল। চারদিক থেকে এতটা সাড়া পেয়েছি, তা আমার পরবরর্তী আর কোনো বইয়ের বেলায় হয়নি। একই বছর বন্ধু বিশ্বজিতের কবিতাই বই ‘তোমার প্রাণের জল শ্যাওলা শরীরে’ প্রকাশিত হয়। এই দুটো বই নিয়ে তখনকার বাংলাদেশ পরিষদ একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনের পাশেই ছিল বাংলাদেশ পরিষদ। তাদের নিজস্ব লাইব্রেরি ও মিলনায়তন ছিল। সেখানে গ্রন্থালোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। এসব আয়োজনের আমরা কিছুই জানতাম না। শুধু অনুষ্ঠানের দিন উপস্থিত ছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে আলোচিত গ্রন্থের লেখক হিসেবে আমাদের কিছু বলার সুযোগ ছিল না।
চমকের আরও অনেক বাকি আছে। চট্টগ্রাম রেডিও আমার বইটি নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান ও আমার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তখনকার বেতার ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান। পরে সাক্ষাৎকারটি যখন প্রচার হয় , তখন নিজের উচ্চারণ ও বাকভঙ্গির শ্রী দেখে খুবই হতাশ হয়েছিলাম।
‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’ প্রকাশের পর তখনকার বড় বড় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকেরা যে দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ভেবে আজও অবাক হই। দৈনিক বাংলা, দৈনিক দেশ, থেকে শুরু করে অনেক পত্রিকায় বইটির গঠনমুলক ও প্রশংসূচক আলোচনা হয়। দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন তখন হেলাল হাফিজ। সেই পত্রিকার প্রায় পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে আমার বইয়ের আলোচনা লিখেছিলেন কবি মোশাররফ করিম। একজন নবীন লেখককে স্বাগত জানাতে, কিংবা তাকে উৎসাহ যোগাতে সাহিত্য সম্পাদকদের এই কর্তব্য পরবর্তী কালে কোথায় যে হারিয়ে গেল তা বোঝার উপায় নেই। ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রয়াত কবি দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায় আমার বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলা কবিতার জগতে এই নবীন কবিকে স্বাগতম। দেবাঞ্জলিকে কখনো দেখিনি। তার কবিতা ও নবীন কবির প্রতি তার মায়া অনুভব করেছি। একটি বইয়ে এত প্রাপ্তি পরবর্তীতে আর কখনো পাইনি।