সাগর আহমেদ »
তাহিতি দ্বীপ থেকে একটা শক্তিশালী স্পিডবোট ভাড়া করে সলমন’স আইল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে কিশোর দলের তিন সদস্য অপু, তিয়ান ও টিয়ানা। উদ্দেশ্যে- নিছক প্রমোদভ্রমণ আর প্রশান্ত মহাসাগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। তারা ভানুয়াতু দ্বীপের কাছে আসতেই নীল তিমির একটা দলের সাথে দেখা হলো। স্পিডবোটটা চালাচ্ছিল অপু।
সে ইঞ্জিন বন্ধ করতে করতে বললো, আরেকটু এগুলে নীল তিমিরা ভড়কে যেতে পারে। আমরা ওদের খেলাধুলা দূর থেকে একটু দেখে যাই।
আধ মাইল দূরে নীল তিমিগুলো খেলাধুলায় মগ্ন। একটা নীল তিমি আকাশে লাফিয়ে উঠলো। তা দেখে টিয়ানা আনন্দে হাততালি দিলো। দুটি নীল তিমি গান গাইছিলো।
তিয়ান বললো, তিমিদের নিজস্ব ভাষা আছে, ওরা গান কম্পোজ করতে পারে।
একথা শুনে টিয়ানা হেসে বলল, দুর ছাই! তুমি মজা করছো। অপু বলল, না, ও সত্যি বলছে। ফারলে মোয়াট নামক এক বিখ্যাত লেখকের বইয়ে আমি তিমিদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। অনেকগুলো তিমি মিলে একটা গোত্র তৈরি করে। প্রত্যেক গোত্রের তিমিদের আলাদা আলাদা ভাষা আর গান আছে। তিমি শিশুরা বাবা- মার সাথে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। তারপর তারা প্রাপ্তবয়স্ক হলে বাবা – মা তাদের আলাদা ছেড়ে দেয়।
টিয়ানা বলল, বাহ্! বেশতো। এমন সময় একটা বড় তিমি মুখ হা করে আকাশে পানির ফোয়ারা সৃষ্টি করলো। বিপুল পানি যেন একসাথে আকাশে উঠে সমুদ্রে ঝরে পড়তে লাগলো। অপু, তিয়ান ও টিয়ানা অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। এর ঘন্টাখানেক পর নীলতিমির দল সেখান থেকে চলে গেলে ওরা আবার এগিয়ে চলল। পথে একঝাঁক রে-ফিস বিদ্যুৎতের ঝলক দেখাতে দেখাতে চলে গেলো । সলমন’স আইল্যান্ডে নেমে ওরা সমুদ্র পাড়ে বসে দেখলো কতগুলো লাল কাঁকড়া পাড় ধরে পিলপিল করে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা বিচ খেউমা বা সমুদ্রের টোকাইদের কাছ থেকে কোক আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিনে মজা করে খেলো । ধীরে ধীরে রাত নেমে এলে ওরা একটা সি-রিসোর্ট ভাড়া করে রাতটা কাটালো।
পরেরদিন খুব ভোরে ওরা সি বিচে ওদের স্পিডবোটটার দিকে এগিয়ে চললো। চারিদিকে সারিসারি নারকেল গাছ আর সমুদ্র থেকে আসা প্রাণ জুড়ানো বাতাস ওদেরকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুললো। এরপর ওরা স্পিডবোটে উঠে সলমন’স দ্বীপ থেকে আরো দক্ষিণে এগিয়ে চলল। এ দিকটায় তেমন একটা মানব বসতি নেই। এখানে দেখা গেলো এক অবাক কান্ড। হাঙ্গর আর পিরানহার জল তোলপাড় করা দুর্দান্ত লড়াই। একটি হাঙ্গর বা পিরানহা মারা যেতেই অন্যেরা তাকে হুটোপুটি করে খেয়ে নিচ্ছে।
এমন সময় তিয়ান চেঁচিয়ে বলল, ওই তো, সামনে একটা অচেনা দ্বীপ। দেখো! ম্যাপে এটার কোনো অস্তিত্ব নেই। ওরা সেই নির্জন দ্বীপের দিকে এগিয়ে চলল। দ্বীপের দিকে কিছুটা এগোতেই এক ঝাঁক উরুক্কু মাছের দেখা মিললো। তারা দলবেঁধে পাতলা ডানা মেলে অনেকটা নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর একদল ডলফিন তাদেরকে লাফিয়ে লাফিয়ে তাড়া করছে। অপু, তিয়ান ও টিয়ানা সেই উরুক্কু মাছ ও ডলফিনের সমান্তরালে চলে দ্বীপের কাছাকাছি চলে এলো। দ্বীপের কাছাকাছি আসতেই সমুদ্র কিছুটা উত্তাল ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। ঢেউয়ের দোলায় স্পিডবোটটা ভয়ংকর ভাবে দুলছে। অপু শক্ত হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলো। অবশেষে কোনোক্রমে ওরা দ্বীপের খাঁড়িতে নোঙর করলো। টিয়ানা এক লাফে দ্বীপে নেমে পড়তেই একটা বড় আকৃতির বুনো টিয়া টিয়ানাকে আক্রমণ করলো। সে টিয়ানার কপালে একটা ঠোকর দিলো। টিয়ানা মাগো বলে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। অপু ওর গুলতি আর বড় মার্বেল পকেট থেকে বের করে পাখিটার বুক সই করে ছুঁড়ে মারলো। পাখিটা দাপটাতে দাপটাতে মাটিতে এসে পড়লো। প্রাণহীন। অপু দেখলো এই বিশাল আকৃতির টিয়া পাখিটার বুকে লাল রঙের ডিজাইন করা। যা হোক, অপু,টিয়ান ও টিয়ানার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। তারা নারকেল গাছ থেকে কচি কচি ডাব পেড়ে প্রান ভরে তার মিষ্টি পানি পান করলো। তারপর কতোগুলো রুটিফল গাছ দেখতে পেয়ে সেখান থেকে রুটিফল ছিঁড়ে নিয়ে আগুন জ্বেলে ওগুলোকে ঝলসে খেলো। অপু মাটির দিকে তাকিয়ে বুঝলো, এটি একটি প্রবাল দ্বীপ। হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাল কীটের মৃতদেহ জমে জমে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই চারিদিকে আগুন জ্বেলে ও অস্থায়ী তাবু খাটিয়ে তারা সেখানে ঘুমাতে গেলো। কিন্তু রাতভর হিংস্র প্রাণীদের গর্জনে তারা ভালোভাবে ঘুমাতে পারলো না। অপুরা বুঝলো আগুন না জ্বাললে ওরা এতক্ষণে হিংস্র প্রাণীদের খাবার হয়ে যেতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ওরা দ্বীপটা ঘুরে দেখতে বেরুলো। প্রবাল দ্বীপের দক্ষিণ দিকের শেষ মাথায় দুটি বড় বড় পর্বত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে বনাঞ্চল। ওরা বনের দিকে এগিয়ে চললো। হঠাৎ একটা চিতাবাঘ আড়াল থেকে তিয়ানের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তিয়ান বিদ্যুৎ গতিতে তার নিত্যসঙ্গী ধারালো চাকুটা চিতাবাঘের ডান রানে গেঁথে দিলো। অপু সাথে সাথে তার বড় বড় মার্বেল আর গুলতি বের করে। চিতাবাঘের বাম চোখে একটা মার্বেল ছুঁড়ে মারলো। চিতাবাঘটা বিকট আর্তনাদ করে বনের গভীরে পালিয়ে গেলো। টিয়ানা বলল, থাক বাবা! বনের আরো গভীরে গিয়ে কাজ নেই। চলো আজকের মতো অস্থায়ী তাঁবুতে ফিরে চলি, কাল পাহাড় দেখতে বের হবো। ওরা ফিরে যেতে যেতে একটা বুনো কলাগাছের ঝাড় থেকে কলা পেড়ে নিলো। তাঁবুর ভিতরে আগে পাড়া কতোগুলো ডাব ছিলো। তিয়ান দ্বীপের এদিকটায় খুঁজে মাটির নিচে খুঁড়ে কতগুলো শাক আলু পেলো। আগুন জ্বেলে সে সেগুলো সিদ্ধ করলো। তারপর সেগুলো দিয়ে ডিনার সেরে তারা তাঁবুর চারিদিকে আগুন জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়লো। গতকাল কম ঘুমানোর কারণে আজ ঘুমটা ভালোই হলো। পরেরদিন ওরা চললো প্রবাল দ্বীপের পাহাড় দুটির দিকে। ওরা প্রথম পাহাড়টায় ক্লাইবিং হুক লাগিয়ে হৈচৈ করতে করতে উঠছিলো। এমন সময় পাহাড়ের বেশ কয়েকটি গুহা থেকে বের হয়ে এলো দানবাকৃতির কতগুলো গরিলা। তারা বুক চাপড়ে, হুংকার দিতে দিতে অপুদের দিকে তেড়ে এলো। অপু পালাতে পালাতে গুলতিতে মার্বেল জুড়ে গরিলাদের দিকে মারতে লাগলো। এতে গেরিলাদের গতি ধীর হয়ে এলো। এই সুযোগে অপু, তিয়ান ও টিয়ানা পিছু হটে স্পিডবোটের দিকে যেতে লাগলো। পথে তিয়ান হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে, ওদের সাথে গরিলা বাহিনীর দূরত্ব কমে এলো। যাহোক, অবশেষে কোনোমতে ওরা স্পিডবোটে পৌঁছে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো। ধীরে ধীরে প্রবাল দ্বীপ পিছু ফেলে ওরা তাহিতির দিকে ফিরে চললো। টিয়ানা পিছনে তাকিয়ে দেখলো গরিলাগুলো পাড়ে তখনো দাঁড়িয়ে আছে আর অগ্নি দৃষ্টি মেলে ওদের দেখছে। তিয়ান আফসোস করতে করতে বললো, এ যাত্রা আমরা হেরে গেলাম! অপু হেসে বলল, এসব ভয়ংকর অভিযানে জয়, পরাজয় দুটোই স্বাভাবিক। আর জানোই তো পাঠ্যবইয়ে লেখা আছে- পরাজয়ে ডরে না বীর! একথা শুনে তিয়ান ও টিয়ানা হো হো করে হেসে উঠলো।