আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ »
মানুষের জীবন কোনো সোজা রেখার সমান্তরাল নয়, এটি এক প্রবহমান নদী, যার বুকে ঢেউ ওঠে, ভাটার টান নামে, কখনো শান্ত, কখনো উন্মত্ত। এই জীবনের স্বাভাবিক চক্রেই মিশে থাকে সাফল্য ও ব্যর্থতা, উত্থান ও পতন। কিছুই স্থায়ী নয়, কিছুই চূড়ান্ত নয়। কিন্তু কিছু একান্ত বিশ্বাস থাকে, যা এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও মানুষকে এগিয়ে যেতে শেখায়। আমার সেই বিশ্বাস প্রত্যাবর্তনে।
প্রত্যাবর্তন আমার কাছে শুধুমাত্র হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়া নয়, বরং এটি একটি আত্মিক প্রস্তুতির ফল, এক গভীর আত্মবোধের পরিণতি। মানুষের জীবন যখন বাধা, ব্যর্থতা, ও ভুল সিদ্ধান্তে ছেয়ে যায়, তখন সে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে আমি কি শেষ হয়ে যাচ্ছি? নাকি এ কেবল এক নতুন সূচনার প্রাক্কাল?
আমার বিশ্বাস, এই প্রশ্নের উত্তরই প্রত্যাবর্তনের বীজ বপন করে। কারণ প্রত্যাবর্তন শুধুই বাহ্যিক সাফল্যের পুনরাবির্ভাব নয়, এটি একান্তই অন্তর্গত রূপান্তর যেখানে মানুষ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে, গড়ে তোলে, এবং ধীরে ধীরে এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়।
বর্তমান মুহূর্তটি সহজ নয়। কিছু পরিকল্পনা ভেঙে পড়েছে, কিছু মানুষ দূরে সরে গেছে, কিছু সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই অনিশ্চয়তা ও অনুতাপের সময়ে কখনো মনে হয়, সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করি এই অস্থিরতা আসলে এক প্রস্তুতির ক্ষেত্র। এটি আমাকে ধৈর্য শেখাচ্ছে, আত্মবিশ্বাস তৈরি করছে, এবং নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে চিনে নিতে সাহায্য করছে।
আমি এখন আগের চেয়ে কম প্রতিক্রিয়াশীল, বেশি পর্যবেক্ষণশীল। মানুষ যেমন শীতের গভীরতা না টের পেলে বসন্তের স্নিগ্ধতা উপলব্ধি করতে পারে না, তেমনি আমি ব্যর্থতার অন্ধকারে না ডুবে থাকলে সাফল্যের আলো কতখানি দ্যুতিময় তা উপলব্ধি করতে পারতাম না। এই অন্ধকারই আমাকে সংহত করছে, সুনিয়ন্ত্রিত করছে, আমার প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে পরিণত করে তুলছে জ্ঞানের সম্পদে।
প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া ধীরে ঘটে, নিঃশব্দে। এটি প্রকাশের আগে দীর্ঘ সময় ধরে নিজেকে প্রস্তুত করে। ঠিক যেমন গাছের ভিতরে অঙ্কুরোদ্গম হয় অনেক আগেই, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই তখনই যখন কুঁড়ি ফোটে। আমিও অনুভব করছি, ভিতরে ভিতরে বদলে যাচ্ছি। যাঁরা একদিন অবজ্ঞা করেছিলেন, তাঁরা এখন লক্ষ্য করতে শুরু করেছেন। যাঁরা সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, এখন প্রশ্ন করছেন আমি কি ফিরে আসছি?
আমি জানি, এটি কোনো তাৎক্ষণিক দৃশ্য নয়। এই প্রত্যাবর্তনের জন্য দরকার ছিল এক দীর্ঘ নিঃশব্দ প্রস্তুতি যেখানে প্রতিটি দিন নিজেকে গড়ার দিন, প্রতিটি রাত এক অভ্যন্তরীণ সংলাপের রাত। আমি প্রস্তুত হচ্ছি, কারণ আমি জানি, সত্যিকারের প্রত্যাবর্তন কোনো বাহ্যিক প্রতিশোধ নয়, এটি একটি মানসিক পূর্ণতা, এক নির্ভীক আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন।
আমার প্রত্যাবর্তন যখন ঘটবে, সেটি আগের অবস্থানে ফেরা নয়। সেটি হবে এক নতুন সত্তার আত্মপ্রকাশ। আমি ফিরে আসব, কিন্তু পুরোনো আমি হয়ে নয় এক নতুন, আরও পরিপক্ব, আরও আত্মপ্রত্যয়ী আমি হয়ে। আমার প্রতিটি পদক্ষেপে তখন থাকবে গভীরতা, আমার সিদ্ধান্তে থাকবে বিচক্ষণতা, আমার দৃষ্টিতে থাকবে স্থিরতা।
আমি জানি, কেউ তা থামাতে পারবে না। কারণ এই প্রত্যাবর্তন আমার ব্যক্তিগত অভিযাত্রা, আমার অস্তিত্বের সারাংশ। আমি আর শুধুই ফিরে আসছি না, আমি নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছি। নতুন আলোয়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, নতুন অভিজ্ঞতার শিখরে নিজেকে পৌঁছে দিচ্ছি। ব্যর্থতা আর ভয় আমার কাছে তখন অতীত হয়ে যাবে স্মৃতির মত, কিন্তু আর নিয়ন্ত্রণহীন নয়।
আমি প্রত্যাবর্তনে বিশ্বাস করি। আর এই বিশ্বাস আমার কাছে কেবল আশার অভিব্যক্তি নয়, এটি এক জীবনদর্শন যেখানে আমি জানি, প্রত্যাবর্তন আসবেই, কেবল সময়ের অপেক্ষা।




















































