অ্যাডভোকেট সেলিম চৌধুরী »
গণমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার কণ্ঠে স্পর্ধিত উচ্চারণ’ ‘আই উইল গো আউট ফ্রম দ্যা পার্লামেন্ট’,বুক ফুলিয়ে, আঙ্গুল উঁচিয়ে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এ কথাগুলো বলেছিলেন চট্টগ্রাম ৮ আসনের প্রয়াত সাংসদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন খান বাদল, তিনি কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের দাবিতে ২০১৯ সালের শুরুতে মহান জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশন চলাকালীন পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যদি কালুরঘাট সেতু নির্মানে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি না হয় ‘আই উইল গো আউট ফ্রম দ্যা পার্লামেন্ট”। আমি এই সংসদ থেকে বিদায় নিব।
হ্যাঁ, সত্যিই তিনি তাঁর কথা রেখেছেন, ডিসেম্বরে আর তাঁকে পার্লামেন্টে যেতে হয়নি, তাঁর আগেই ৭ নভেম্বর ২০১৯ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। চিরবিদায় নিলেন পার্লামেন্ট থেকে, চিরবিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে।
২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনিই সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণের গুরুত্ব ও দাবি তুলে প্রস্তাব রেখেছিলেন মহান জাতীয় সংসদে।
যার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাদলের স্বপ্নের কালুরঘাট সেতু নির্মাণের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিলেন। অবশেষে কিছুদিন আগে রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুনজ, কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এলাকার উন্নয়ন, দেশপ্রেমই ছিল মঈন উদ্দিন খান বাদলের রাজনৈতিক পুঁজি, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রদত্ত একেকটি বক্তৃতা যেন একেকটি অনবদ্য দলিল হয়ে রয়ে গেল সংসদ আর্কাইভে, কোটি মানুষের হৃদয়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়জন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাতীয় অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করেছেন তার মধ্যে মঈন উদ্দীন খান বাদল ছিলেন অন্যতম। তিনি শুধু একজন স্বাধীনচেতা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন বড় মাপের দার্শনিকও।
তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার দিকদর্শন ছিল গণ-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জাতীয় ইস্যুগুলোতে তাঁর ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ভূমিকা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করত। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদীয় রীতি-নীতি পালনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মঈন উদ্দিন খান বাদল।
সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা,তথ্যবহুল দিকনির্দেশনামুলক বক্তব্য জাতীয় সংসদকে সমৃদ্ধ করেছে যার পরিপ্রেক্ষিত দশম জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সংসদ অধিবেশন চলাকালীন একদিন বলে উঠেছিলেন, ‘মাননীয় সাংসদগণ. আপনারা মঈন উদ্দীন খান বাদল কে অনুসরণ করতে পারেন, তিনি একদিকে যেমন দেশীয় রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন তেমনি বহির্বিশ্বে দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
মায়ানমার সেনাবাহিনী যখন নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল তখন মায়ানমারের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ। তিনি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম স্থপতি। এর মাধ্যমে তিনি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির সমাবেশ ঘটান যা পরবর্তীকালে ঐক্যমতের সরকার গঠনে সহায়ক হয়।
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রলীগের রাজনীতির মাঠ থেকে ওঠে আসা ছাত্রনেতা মঈন উদ্দীন খান বাদল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর আহবানে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমান্ডোদের সাথে নিয়ে তাঁর অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা ও সফল অপারেশনের মাধ্যমে ৭টি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়।
১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদÑএ যোগদান করেন। রাজপথ থেকে সংসদ সবর্ত্রই সমান বিচরণ করা এই মানুষটি তেমন বড় কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও, বিশাল কর্মী বাহিনী না থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, মেধা, যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে যোগ্য জাতীয় নেতা হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন কোটি জনতার হৃদয়ে। ‘মঈন উদ্দীন খান বাদল এক নামেই দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এটিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। এখনো তাঁর শূন্যতায় অসংখ্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
লেখক : আইনজীবী